শ্রমিক সুরক্ষায় আইন থাকলেও কার্যকর কতটা ?

- আপডেট সময় : ১২:৩৫:০৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫ ২০ বার পড়া হয়েছে
সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনের প্রথা ছিল।
তবে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে শিল্পায়নের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। একদা মানুষকে কৃতদাস হিসেবে বিক্রি করা হতো। কালের বিবর্তনে কৃতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি নানা বৈষম্য রয়েই গেছে। বিভিন্ন সময়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনগত কাঠামোও তৈরি হয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে-এসব আইন যতটা সুন্দরভাবে কাগজে লেখা আছে, বাস্তবে তার প্রয়োগ ততটাই দুর্বল।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের সুরক্ষায় একাধিক আইন ও বিধিমালা রয়েছে। শ্রম আইন ২০০৬ এবং এর সংশোধিত রূপে শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮, শ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মঘণ্টা, ন্যূনতম মজুরি ও ছুটির অধিকারসহ নানান মৌলিক অধিকারের কথা বলেছে।
বিশেষ করে পোশাকশিল্প, নির্মাণ খাত এবং পরিবহন খাতে কাজ করা শ্রমিকরা প্রায়শই কর্মস্থলে ঝুঁকি, নিরাপত্তাহীনতা এবং সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ার মতো সমস্যার মুখোমুখি হন। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেয় না, এমনকি স্বাস্থ্য, বিমা বা ভবিষ্যৎ তহবিলের মতো মৌলিক সুবিধাও থাকে না তাদের ক্ষেত্রে।
পরিদর্শক সংকট, দুর্বল তদারকি এবং মালিকপক্ষের গাফিলতিতে প্রতিদিন ঝুঁকির মুখে শ্রমজীবী মানুষ। আন্তর্জাতিক বাজারেও চাপ বাড়ছে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার। দেশে শ্রমিকরা আইনি অধিকার ও সুরক্ষা থেকে কীভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন সে বিষয়ে আইনজীবীরা তাদের মতামত তুলে ধরছেন।
শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, কাজের সময় দুর্ঘটনায় আক্রান্ত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ, চাকরির অবস্থা ও পরিবেশসহ সংশ্লিষ্ট বিষয় মাথায় নিয়ে শ্রম আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
আইনে শ্রমিকদের নানান ধরনের অধিকারের কথা থাকলেও তারা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিশুদের কম মজুরি, নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি না দিয়ে ছাঁটাই, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ না দেওয়া এবং বর্তমানে আউট সোর্সিংসহ নানান কারণে শ্রমিকরা তাদের আইনি সুরক্ষা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত বলে মনে করেন শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, বর্তমানে শ্রমিকদের অনেকেই মালিকের সঙ্গে তৃতীয়পক্ষের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ তথা আউটসোর্সিংয়ের কারণে শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বলে মনে করেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে কাগুজে আইন নয়, দরকার তার কার্যকর প্রয়োগ। শ্রম পরিদর্শক বাড়ানো, কারখানা তদারকিতে কঠোরতা এবং মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনলেই কেবল এ চিত্র বদলানো সম্ভব।
বাংলাদেশ শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত প্রায় ৪৮ হাজার কারখানার জন্য পরিদর্শক আছেন মাত্র কয়েকশ। পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে শ্রমিকদের সুরক্ষা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের এক জরিপে জানা গেছে, ৭১ শতাংশ শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ পাচ্ছেন না।
পোশাকশ্রমিক রায়হান মিয়া বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন কোম্পানির বেঁধে দেওয়া সময়ে কাজ করি। মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত সময়ও কাজ করতে হয়। কিন্তু ওভারটাইমের টাকা ঠিকমতো দেয় না। নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কথা বললেই চাকরি চলে যাওয়ার ভয় দেখায়।’
আইনি সুরক্ষা ও অধিকারের কথা আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আইন আছে, কিন্তু এর প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে। যদি আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যেত, তাহলে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।’
জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, ‘বর্তমানে আউটসোর্সিংয়ের প্রবণতা বাড়ার কারণে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য কমিশন, গ্র্যাচুইটি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড কোনো কিছুই ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আমরা যেটির নাম দিয়েছি মডার্ন লেবারি। এর কারণে মে দিবসের অধিকার চর্চার কথাও ঠিকঠাক বলা যাচ্ছে না। মালিক স্থায়ী কাজে অস্থায়ী লোক নিয়োগ দিচ্ছে। যে কারণে সব জায়গায় লোক নিচ্ছে কিন্তু এক শ্রেণির সুবিধাভোগী মালিকের সঙ্গে দেখা করে তাদেরটা কামিয়ে নিচ্ছেন। বাস্তবতা হলো তদারকির কথা বলে ওনারা নিচ্ছেন কিন্তু সঠিক তদারকি হচ্ছে না।’
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, শ্রমিকদের সুরক্ষা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি টেকসই অর্থনীতির পূর্বশর্ত। শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে কেবল আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ও নজরদারি নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে জরুরি।
কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা-সমন্বয় জোরদারে সরকারি (শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, শ্রম শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তন আইআরআই, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র জবাবদিহিতা থাকার কথা বলা হলেও সেটি নেই।
‘সব শ্রমিকের সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার প্রাপ্তির (কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, মৃত্যু, কর্মক্ষমতা, অসুস্থতা-অবসর, মাতৃত্বকালীন সুবিধা বা যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা) নারী-পুরুষ, অন্যান্য লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীভেদে মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াসহ শ্রম খাতের সর্বত্র বৈষম্য নয় সম-অধিকার নিশ্চিতে কার্যক্রম গ্রহণ করবে রাষ্ট্র। কিন্তু কোনো কিছুতেই কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব নেই।’ বলেন অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ।