যে কারণে বাংলাদেশে চালু হচ্ছে অফশোর ব্যাংকিং
- আপডেট সময় : ১০:০৩:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৬৮ বার পড়া হয়েছে
বিদেশি বিনিয়োগকারী ও অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পাঁচটি বিদেশি মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ রেখে অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বুধবার তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ আইনের মাধ্যমে অনিবাসী ব্যক্তি বা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান যারা এখানে ইনভেস্ট করবে তারা অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। যারা লাইসেন্স নেবে তারা এসব অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে।
যে পাঁচটি মুদ্রায় এসব অ্যাকাউন্টে ব্যাংকিং কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে সেগুলো হলো— মার্কিন ডলার, পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চাইনিজ ইউয়ান।
বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত কোনো আইন না থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশে অফশোর ব্যাংকিং চালু আছে ১৯৮৫ সাল থেকে। পরে ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর কয়েকটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। এখন এ বিষয়ে আইন করা হচ্ছে।
ব্যাংকিং সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে নতুন যে আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট ও এলসি খোলার সংকট সমাধানসহ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে। তারা বলছেন, কোনো ব্যক্তি নয় বরং আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই এই আইন জরুরি ছিল।
অফশোর ব্যাংকিং কি?
অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরেই আরেকটি পৃথক ব্যাংকিং সেবা। প্রচলিত ব্যাংকিং বা শাখার কার্যক্রমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন অফশোর ব্যাংকিং। কারণ এ জাতীয় কার্যক্রমে আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়ার দুই কার্যক্রমই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশি গ্রাহকদের দেওয়া হয়। এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসীদের মধ্যেই সীমিত থাকে।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব করা হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা প্রয়োগ করা হয় না। আলাদা আইনের মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিং পরিচালিত হয় ও এ সংক্রান্ত হিসাব সংরক্ষণ করা হয়।
ব্যাংকগুলো অফশোর ইউনিট থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়ে থাকে। এটি এমন ব্যাংকিং কার্যক্রম যা শুধুমাত্র অনিবাসীদের যেমন- মাল্টিন্যাশনাল পণ্য, সেবা এবং ফাইন্যান্সারদের সম্পৃক্ত করে। এটি দেশীয় ব্যাংকিংয়ের সাথে যুক্ত হয় না।
নতুন আইনে যা আছে
বুধবার অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। এর ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে। শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতেই অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। অবশ্য যাদের লাইসেন্স আছে তাদের নতুন করে নিতে হবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে তারা বিদেশি বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে। এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশি বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে। বিদেশে বসবাসকারী যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিকের পক্ষে দেশে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তারা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন।
লাইসেন্স নিতে হবে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে
বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের উপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনো কর দিতে হবে না।
একই সাথে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে তার ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনো সুদ বা চার্জ দিতে হবে না।
বর্তমানে অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে আমানত নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এ আইনটি পাস হলে তফসিলি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটগুলো বিদেশিদের পাশাপাশি অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকেও আমানত নিতে পারবে।
অনুমোদিত নতুন আইনে কোনো ঋণসীমা রাখা হয়নি, এতে যেকোনো পরিমাণ লেনদেন করা যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিজেডে যে অফশোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে তা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে কোনো লাভ দেওয়া হয় না। তবে নতুন আইনে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে লাভ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধা-অসুবিধা
ব্যাংকাররা বলছেন, এই ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অসুবিধার চাইতে সুবিধাই বেশি। এই ব্যাংকিংয়ে কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি দেশ-বিদেশে সহজ শর্তে ব্যবসা করতে পারবে।
এ ব্যবস্থায় গ্রাহকের তথ্য সংক্রান্ত চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হবে। তবে এতে অসুবিধাও আছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছে, অফশোরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে লোন নিয়ে দেশে ব্যবসা করছে, দেশে লোন শোধ করছে। এক্ষেত্রে তার এক্সপোর্ট সেভাবে না থাকলে ওই লোন শোধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
তিনি বলেন, তার মানে তাকে উল্টো করে লোকাল টাকা দিয়ে লোন শোধ করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত এক্সপোর্টের মাধ্যমে কাভার না করলে ওই লোন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে।
এ সমস্যা রোধে তদারকি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন নুরুল আমিন। তিনি বলেন, যে কারণে লোন দেয়া হচ্ছে সেটা পালন হচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং জরুরি। তিনি আরও বলেন, এই কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। কারণ যারা এতে অংশ নেবে তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের রেস্ট্রিকশন কম থাকবে। কারণ ফরেন কারেন্সির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অনেক উদার করা হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। অনাবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশ থেকে যখন দেশে থাকা অফশোর ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাবে, তখন সেই মুদ্রাতেই লেনদেন করবে।
এছাড়া এ ধরনের অ্যাকাউন্টধারীদের সরকার প্রচুর ট্যাক্স বেনিফিট দিয়ে থাকে।
ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তারা আরও জানান, কোনো অনাবাসী ব্যক্তি বা কোম্পানি যখন বাংলাদেশের অফশোর অ্যাকাউন্টে বিদেশি মুদ্রা পাঠাবে তখন সে নিজের প্রয়োজনে এই অর্থ নিতে পারবে। পরিবারের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। আবার টাকায় এনক্যাশ করে শেয়ার বা বন্ড কিনতে পারবে।
মূলত বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো, রিজার্ভ সংকট, এলসি খোলার সংকট সমাধানে এই অফশোর ব্যাংকিংয়ের নতুন আইন কাজ করবে বলে মনে করছেন ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তারা।