ঢাকা ০৪:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভুয়া এনজিও’র ফাঁদে সাধারণ মানুষ নি:স্ব

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিবেদকঃ
  • আপডেট সময় : ১১:০৭:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ মে ২০২৩ ৯৬ বার পড়া হয়েছে

পঁয়ত্রিশ হাজার পরিবারের লাখ লাখ মানুষের চোখের পানিও কি আপনাদের কাছে মূল্যহীন? আমাদের প্রতি কোনো দয়া মায়া হয় না? এতোগুলো মানুষের ১০৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে যারা বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? আমরা কি করব, কোথায় যাব? কার কাছে গেলে আমানতের টাকা ফেরত পাব? জনগণের টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এই টাকার জন্য এখন সংসার হারাতে বসেছি। এতোগুলো মানুষ সবাই মিলে আমরা জীবন দিলে কি আপনাদের টনক নড়বে?’

রোববার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন সদর উপজেলার বাসুদেবপুর এলাকার গৃহবধূ খালেদা খাতুন (৩৪)। তিনিসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবৈধ ও অনিবন্ধিত ভুয়া এনজিও মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় থাকা ৩৫ হাজার গ্রাহকের আমানতের ১০৫ কোটি টাকা ফেরতের দাবিতে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় ৭ শতাধিক গ্রাহক। এ সময় গ্রাহকেরা ভুয়া এনজিওর মালিক ও টাকা আত্মসাতকারীদের বিরুদ্ধে করা কয়েকটি মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে তাদের টাকা ফেরতের দাবি জানান।

খালেদা খাতুন বলেন, জমি কেনার জন্য অনেক কষ্টে টাকাগুলো মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার বাসুদেবপুর শাখায় জমা রেখেছিলাম। টাকা নেওয়ার সময় তারা বলেছিল, যখন চাইবেন তখনই ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু জমি কেনার জন্য টাকা চাইতে গেলে তা ফেরত দিচ্ছে না। আমার স্বামী এখন আমাকে এই টাকা না দেওয়ার জন্য তালাক দিতে চায়। আমি সংসার হারার উপক্রম হয়েছি। প্রশাসনের কাছে বারবার গেলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের স্নাতক পড়ুয়া লতিফা খাতুন বলেন, আমার কোনো ভাই নেই। বাবার উপার্জনের ৬ লাখ টাকা মধুমতি এনজিওতে জমা রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পরেও এখন চিকিৎসা করার জন্য টাকা উত্তোলন করতে পারছি না। বারবার এনজিও অফিসে ঘুরেও দেব দেব বলে দিচ্ছে না। টাকার জন্য এখন অসহায়ের মতো দিন পার করছি।

জেলা শহরের বিজয় নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সানজিদা খাতুন জানান, জমি বিক্রি করে টাকা জমা রেখেছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা তুলে বেতন দিতাম। কিন্তু কয়েকমাস থেকে টাকা আত্মসাত করে পালিয়েছে এর মালিক পক্ষের লোকজন। এখন কলেজের বেতন দিতে পারছি না। মামলা হলেও আসামিদের আটক করা হচ্ছে না। জনগণের টাকা নিয়ে যে সমস্ত সম্পদ তৈরি করেছে, তা বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

নাচোল উপজেলার নেজামপুরের কাজল মুখার্জির স্ত্রী টুম্পা মুখার্জি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে দিনমজুর স্বামীর জমানো টাকা রেখেছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামের এনজিও-তে। জমি কেনার জন্য টাকা জমা টাকা না পেয়ে শেষ হয়ে গেছি। আমার মতো এলাকার হাজারো মানুষের অবস্থা এমন।

অন্যের জমিতে কাজ করে নিজের জমানো ও গরু বিক্রির ৭০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন স্বামী হারানো পান মুনি (৬৫)। তিনি জানান, টাকাগুলো আবার ফেরত পেলে ভাঙা ঘর ঠিক করতাম। কিন্তু কয়েকমাস থেকে টাকা দিতে নানারকম টালবাহানা শুরু করেছে। এখন তো তাদের অফিসও বন্ধ রয়েছে। শুনেছি এনজিও মালিক মাসুদ রানা নাকি মিথ্যা নাটক সাজিয়ে কারাগারে আরামে দিন পার করছি।

মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এসলাম হোসেন বলেন, এ বিষয়ে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। গ্রাহকেরা মামলাগুলোর আসামিদের গ্রেপ্তার ও টাকা ফেরতের বিষয়ে কি অবস্থায় রয়েছে, তা জানতেই গ্রাহক ও এনজিও কর্মীরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ মুঠোফোনে বলেন, কয়েকজন আসামির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে এবং কয়েকজন আদালত থেকে জামিনে রয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলা চলমান রয়েছে। আসামিদেরকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এবিষয়ে জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি-এমআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম পরিচালনা অবৈধ। মধুমতির বিষয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। অন্যদিকে আদালতে মামলা চলমান আছে।

এর আগে ২ এপ্রিল বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে টাকা ফেরতের দাবিতে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে গ্রাহকেরা। আগের দিন ১ এপ্রিল একই দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে গ্রাহকেরা। এছাড়াও গত ৯ মার্চ শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে একটি মানববন্ধন করে ইউএনও অভিযোগ দেন তারা।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভুয়া এনজিও’র ফাঁদে সাধারণ মানুষ নি:স্ব

আপডেট সময় : ১১:০৭:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ মে ২০২৩

পঁয়ত্রিশ হাজার পরিবারের লাখ লাখ মানুষের চোখের পানিও কি আপনাদের কাছে মূল্যহীন? আমাদের প্রতি কোনো দয়া মায়া হয় না? এতোগুলো মানুষের ১০৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে যারা বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? আমরা কি করব, কোথায় যাব? কার কাছে গেলে আমানতের টাকা ফেরত পাব? জনগণের টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এই টাকার জন্য এখন সংসার হারাতে বসেছি। এতোগুলো মানুষ সবাই মিলে আমরা জীবন দিলে কি আপনাদের টনক নড়বে?’

রোববার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন সদর উপজেলার বাসুদেবপুর এলাকার গৃহবধূ খালেদা খাতুন (৩৪)। তিনিসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবৈধ ও অনিবন্ধিত ভুয়া এনজিও মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় থাকা ৩৫ হাজার গ্রাহকের আমানতের ১০৫ কোটি টাকা ফেরতের দাবিতে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় ৭ শতাধিক গ্রাহক। এ সময় গ্রাহকেরা ভুয়া এনজিওর মালিক ও টাকা আত্মসাতকারীদের বিরুদ্ধে করা কয়েকটি মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে তাদের টাকা ফেরতের দাবি জানান।

খালেদা খাতুন বলেন, জমি কেনার জন্য অনেক কষ্টে টাকাগুলো মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার বাসুদেবপুর শাখায় জমা রেখেছিলাম। টাকা নেওয়ার সময় তারা বলেছিল, যখন চাইবেন তখনই ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু জমি কেনার জন্য টাকা চাইতে গেলে তা ফেরত দিচ্ছে না। আমার স্বামী এখন আমাকে এই টাকা না দেওয়ার জন্য তালাক দিতে চায়। আমি সংসার হারার উপক্রম হয়েছি। প্রশাসনের কাছে বারবার গেলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের স্নাতক পড়ুয়া লতিফা খাতুন বলেন, আমার কোনো ভাই নেই। বাবার উপার্জনের ৬ লাখ টাকা মধুমতি এনজিওতে জমা রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পরেও এখন চিকিৎসা করার জন্য টাকা উত্তোলন করতে পারছি না। বারবার এনজিও অফিসে ঘুরেও দেব দেব বলে দিচ্ছে না। টাকার জন্য এখন অসহায়ের মতো দিন পার করছি।

জেলা শহরের বিজয় নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সানজিদা খাতুন জানান, জমি বিক্রি করে টাকা জমা রেখেছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা তুলে বেতন দিতাম। কিন্তু কয়েকমাস থেকে টাকা আত্মসাত করে পালিয়েছে এর মালিক পক্ষের লোকজন। এখন কলেজের বেতন দিতে পারছি না। মামলা হলেও আসামিদের আটক করা হচ্ছে না। জনগণের টাকা নিয়ে যে সমস্ত সম্পদ তৈরি করেছে, তা বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

নাচোল উপজেলার নেজামপুরের কাজল মুখার্জির স্ত্রী টুম্পা মুখার্জি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে দিনমজুর স্বামীর জমানো টাকা রেখেছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামের এনজিও-তে। জমি কেনার জন্য টাকা জমা টাকা না পেয়ে শেষ হয়ে গেছি। আমার মতো এলাকার হাজারো মানুষের অবস্থা এমন।

অন্যের জমিতে কাজ করে নিজের জমানো ও গরু বিক্রির ৭০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন স্বামী হারানো পান মুনি (৬৫)। তিনি জানান, টাকাগুলো আবার ফেরত পেলে ভাঙা ঘর ঠিক করতাম। কিন্তু কয়েকমাস থেকে টাকা দিতে নানারকম টালবাহানা শুরু করেছে। এখন তো তাদের অফিসও বন্ধ রয়েছে। শুনেছি এনজিও মালিক মাসুদ রানা নাকি মিথ্যা নাটক সাজিয়ে কারাগারে আরামে দিন পার করছি।

মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এসলাম হোসেন বলেন, এ বিষয়ে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। গ্রাহকেরা মামলাগুলোর আসামিদের গ্রেপ্তার ও টাকা ফেরতের বিষয়ে কি অবস্থায় রয়েছে, তা জানতেই গ্রাহক ও এনজিও কর্মীরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ মুঠোফোনে বলেন, কয়েকজন আসামির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে এবং কয়েকজন আদালত থেকে জামিনে রয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলা চলমান রয়েছে। আসামিদেরকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এবিষয়ে জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি-এমআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম পরিচালনা অবৈধ। মধুমতির বিষয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। অন্যদিকে আদালতে মামলা চলমান আছে।

এর আগে ২ এপ্রিল বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে টাকা ফেরতের দাবিতে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে গ্রাহকেরা। আগের দিন ১ এপ্রিল একই দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে গ্রাহকেরা। এছাড়াও গত ৯ মার্চ শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে একটি মানববন্ধন করে ইউএনও অভিযোগ দেন তারা।