ঢাকা ০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গুলি, বোমাবাজি, দখলদারিতে আতঙ্কিত দেবহাটার জনপদ

দেশের আওয়াজ ডেস্কঃ
  • আপডেট সময় : ০৬:২৪:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ৮৬ বার পড়া হয়েছে

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালীতে এক হাজার তিনশত বিশ বিঘার চিংড়ি ঘের দখলকে কেন্দ্র করে ঘেরাঞ্চলের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ফিল্মি স্টাইলে প্রকাশ্যে গুলি ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চিংড়ি ঘের দখলের নেপথ্যে রয়েছে চিহ্নিত ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি ও রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রশ্রয়ের সন্ত্রাসীরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার খলিশাখালীতে প্রায় ২০০ ব্যক্তির নামে রেকর্ডীয় মালিকানা সম্পত্তি ৩০ খন্ডে বিভক্ত ৪৩৯.২০ একর বা ১,৩২০ বিঘা জমিতে চিংড়ি মাছের ঘের ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে দেবহাটা ও কালিগঞ্জ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীরা, মাদক ব্যবসায়ী ও ভূমিদস্যুরা বোমাবাজি ও গুলি ছুঁড়ে দখল করে নেয়।

ওই ১৩২০ বিঘা বা ৪৩৯.২০একর জমির মালিকরা জানান, ‘খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের দখলের সাথে রয়েছে- বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ডাকাত সর্দার, কথিত ভূমিহীন নেতা, ও একাধিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। ভূমিদস্যু দখলদার সন্ত্রাসীরা হলেন- পারুলিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ও একাধিক নাশকতা মামলার আসামী আনারুল ইসলাম, পারুলিয়া ৯নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি আবুল হোসেন, আওয়ামীলীগ নেতা ইউপি সদস্য ইসমাইল হোসেন, ঢেপুখালীর ডাকাত সর্দার আকরাম হোসেন, দেবহাটা নাংলার আব্দুল গফুর ডাকাত, খলিশাখালীর কালু ডাকাত, সাইফুল ইসলাম, আসাদুল ইসলাম, ভূমিদস্যু রবিউল ইসলাম, মাদক ব্যবসায়ী রিপন হোসেন, নওয়াপাড়ার সুনীল স্বর্ণকার, শরিফুল ইসলাম ও চালতেতলার আরিফ পাড়। এসব সন্ত্রাসীদের নেপথ্যে প্রকাশ্যে মদদ দেন খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের দখল কর্মযজ্ঞের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করা রঘুনাথ খাঁ।’

সশস্ত্র ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সন্ত্রাসীরা দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার খলিশাখালীর ব্যক্তি মালিকানাধীন রেকর্ডীয় সম্পত্তি সরকারের খাস সম্পত্তি বলে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালিয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক বরাবর তাদের অনুকূলে ভূমি বন্দোবস্ত নেয়ার আবেদন করেন। ভূমিদস্যুদের এই আবেদনের কথা জানতে পেরে ঐ জমির প্রকৃত মালিকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ঐ জমি থেকে সশস্ত্র ভূমিদস্যুদের সরানোর জন্য কাজী আব্দুল মালেক এর ওয়ারেশগণ প্রতিকার চেয়ে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। জমির প্রকৃত মালিকদের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় ৪৩৯.২০ একর জমির সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করেন। জমির সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরের ৪৩৯.২০ একর সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি। ঐ সম্পত্তি খাস সম্পত্তি নয়। এই জমিতে অবৈধভাবে দখলদার ভূমিদস্যুদের সরিয়ে দিয়ে প্রকৃত মালিকদের কাছে ঐ জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিদস্যু ও দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। “বর্তমান সরকার ভূমিহীনদের ভূমি ও গৃহহীনদের সরকারি খাস সম্পত্তিতে গৃহ বানিয়ে দিচ্ছেন। উক্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি ভূমিহীনদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।”

সে মোতাবেক খলিশাখালীতে অবস্থানরত ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের দখলমুক্ত করার জন্য জেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় পাস হওয়া রেজুলেশনের অনুলিপি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ১৯টি দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেন। এরপর ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দখলদার ভূমিদস্যুদের দখলমুক্ত ও উচ্ছেদ করে খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরটি জমির প্রকৃত মালিকরা ফেরত পান।
খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরের জমি ফেরত পেয়ে মালিকগণ আবারও মাছ চাষ শুরু করেন। মালিকপক্ষ খলিশাখালীর ৪৩৯.২০ একর সম্পত্তি বা জমি শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করাকালীনসময়ে রঘুনাথ খাঁ বেশ কিছুদিন যাবৎ দেবহাটার শিমুলিয়া বাজারে কাজী গোলাম ওয়ারেশের ছেলে ঘের মালিক কাজী সুরুজ ওয়ারেশ এর কাছে মোটা অংকের টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। দাবীকৃত চাঁদার টাকা না দিলে রঘুনাথ খাঁ মিথ্যা সংবাদ প্রকাশসহ নানা ধরনের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে ২৩ জানুয়ারি তারিখে রঘুনাথ খাঁ সহ সন্ত্রাসীরা ঘের দখলের প্রস্তুতিকালে পুলিশের হাতে ককটেল সহ ধরা পরে।

দেবহাটার খলিশাখালীর ঘের মালিকদের একজন কাজী সুরুজ ওয়ারেশ বলেন, “২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রঘুনাথ খাঁ, আনারুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম গাজীরহাট বাজারে আমার অফিসে এসে ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং ২ দিনের মধ্যে তাদের দাবিকৃত টাকা না দিলে ভুমিদস্যুদের দিয়ে তার সকল চিংড়ি ঘের দখল করিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে পরের দিন ২২ জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রঘুনাথ খাঁ দেবহাটা থানাধীন খলিশাখালী গ্রামের সাপমারা খালের ব্রীজের পাশে বসে দখলদার ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের সাথে পরামর্শ করে পুনরায় ঘের দখলের প্রস্তুতি নেন এবং সাপমারা ব্রীজের উপর গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্রীজ উপর দিয়ে জন সাধারণের চলাচল বন্ধ করে দেন। ২৩ জানুয়ারি সোমবার আনুমানিক রাত ৪টার দিকে প্রায় ১০০জন ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি ও সন্ত্রাসীরা গুলি ছুঁড়ে ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরে প্রবেশ করলে ঘের মালিকের পাহারাদাররা ঘের থেকে ভয়ে ও আতঙ্কে পালিয়ে যায়।’

দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ ওবায়দুল্লাহ মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘২৩ জানুয়ারি সোমবার আনুমানিক রাত ৪টার দিকে প্রায় ১০০জন ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি ও সন্ত্রাসীরা গুলি ছুঁড়ে ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরে প্রবেশ করার ঘটনা জানতে পেরে দেবহাটা থানা পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার জন্য অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থলে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের মৃত মদন মহন খাঁ এর ছেলে রঘুনাথ খাঁ (৫৭), দেবহাটা উপজেলার ঢেপুখালী গ্রামের মৃত ফজর আলী গাজী এর ছেলে রেজাউল করিম (৬৩) ও চালতেতলা গ্রামের নওশের হাওলাদার এর ছেলে মোঃ লুৎফর রহমান (৪৫) কে পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ৫টি ককটেল সহ বিস্ফোরিত ককটেলের অংশ, কাঠের গুড়ি, লাঠিসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। আসামীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে।”

এ ঘটনায় ঘের মালিক কাজী গোলাম ওয়ারেশ এর ছেলে কাজী সুরুজ ওয়ারেশ গ্রেফতারকৃত ৩জনসহ ১৫জন পলাতক এবং ২০/২৫ জন অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামী করে দেবহাটা থানায় ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে এবং ১৯৭৪ সালের দ্য স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং- ০৮, তাং- ২৩জানুয়ারি’ ২০২৩। পরের দিন ২৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে খলিশাখালীর ঘের মালিকগণ গ্রেফতারকৃত আসামী ও সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে বক্তরা বলেন, এই মামলার আসামীরা নানা কারণেই থাকছে ধরা ছোয়ার বাইরে। আসামীদের কাছে প্রশাসনও অসহায়। ফলে মামলার বাদী ও খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের মালিকগণ ও স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ কারণে স্থানীয় জনগণ আসামীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন।

পারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু ভীতির সুরে জানান, ‘ওই জমিটি মালিকানা বলেই জানি। কাজী গোলাম ওয়ারেশ ও তাদের শরীকরা ওই জমি দীর্ঘদিন যাবৎ ভোগ দখল করছে। অন্যদের এই জমি দখল দুঃখজনক। এর থেকে বেশি আমি বলতে পারবোনা। ’

এ বিষয়ে জানতে দেবহাটা উপজেলা ভাইস চেয়ারাম্যান হাবিবুর রহমান সবুজের মোবাইলে বার বার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জেলা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান জানান, ন্যায্যতা নিয়ে জমির মাীলকরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে যাচাই বাছাই করা হয়। সর্বশেষ দেখা গেছে মালিকানাধীন জমি একটা দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেট জবর দখল করে ফায়দা লুটতে চায়। ডাকাত, চাঁদাবাজ, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট গুলি-বোমার মুখে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি জবর দখলে রাখতে চায়। আমি সাতক্ষীরায় যোগদান করার পর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। সন্ত্রাসীরা আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবেনা।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

গুলি, বোমাবাজি, দখলদারিতে আতঙ্কিত দেবহাটার জনপদ

আপডেট সময় : ০৬:২৪:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালীতে এক হাজার তিনশত বিশ বিঘার চিংড়ি ঘের দখলকে কেন্দ্র করে ঘেরাঞ্চলের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ফিল্মি স্টাইলে প্রকাশ্যে গুলি ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চিংড়ি ঘের দখলের নেপথ্যে রয়েছে চিহ্নিত ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি ও রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রশ্রয়ের সন্ত্রাসীরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার খলিশাখালীতে প্রায় ২০০ ব্যক্তির নামে রেকর্ডীয় মালিকানা সম্পত্তি ৩০ খন্ডে বিভক্ত ৪৩৯.২০ একর বা ১,৩২০ বিঘা জমিতে চিংড়ি মাছের ঘের ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে দেবহাটা ও কালিগঞ্জ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীরা, মাদক ব্যবসায়ী ও ভূমিদস্যুরা বোমাবাজি ও গুলি ছুঁড়ে দখল করে নেয়।

ওই ১৩২০ বিঘা বা ৪৩৯.২০একর জমির মালিকরা জানান, ‘খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের দখলের সাথে রয়েছে- বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ডাকাত সর্দার, কথিত ভূমিহীন নেতা, ও একাধিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। ভূমিদস্যু দখলদার সন্ত্রাসীরা হলেন- পারুলিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ও একাধিক নাশকতা মামলার আসামী আনারুল ইসলাম, পারুলিয়া ৯নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি আবুল হোসেন, আওয়ামীলীগ নেতা ইউপি সদস্য ইসমাইল হোসেন, ঢেপুখালীর ডাকাত সর্দার আকরাম হোসেন, দেবহাটা নাংলার আব্দুল গফুর ডাকাত, খলিশাখালীর কালু ডাকাত, সাইফুল ইসলাম, আসাদুল ইসলাম, ভূমিদস্যু রবিউল ইসলাম, মাদক ব্যবসায়ী রিপন হোসেন, নওয়াপাড়ার সুনীল স্বর্ণকার, শরিফুল ইসলাম ও চালতেতলার আরিফ পাড়। এসব সন্ত্রাসীদের নেপথ্যে প্রকাশ্যে মদদ দেন খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের দখল কর্মযজ্ঞের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করা রঘুনাথ খাঁ।’

সশস্ত্র ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সন্ত্রাসীরা দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার খলিশাখালীর ব্যক্তি মালিকানাধীন রেকর্ডীয় সম্পত্তি সরকারের খাস সম্পত্তি বলে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালিয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক বরাবর তাদের অনুকূলে ভূমি বন্দোবস্ত নেয়ার আবেদন করেন। ভূমিদস্যুদের এই আবেদনের কথা জানতে পেরে ঐ জমির প্রকৃত মালিকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ঐ জমি থেকে সশস্ত্র ভূমিদস্যুদের সরানোর জন্য কাজী আব্দুল মালেক এর ওয়ারেশগণ প্রতিকার চেয়ে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। জমির প্রকৃত মালিকদের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় ৪৩৯.২০ একর জমির সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করেন। জমির সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরের ৪৩৯.২০ একর সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি। ঐ সম্পত্তি খাস সম্পত্তি নয়। এই জমিতে অবৈধভাবে দখলদার ভূমিদস্যুদের সরিয়ে দিয়ে প্রকৃত মালিকদের কাছে ঐ জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিদস্যু ও দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। “বর্তমান সরকার ভূমিহীনদের ভূমি ও গৃহহীনদের সরকারি খাস সম্পত্তিতে গৃহ বানিয়ে দিচ্ছেন। উক্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি ভূমিহীনদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।”

সে মোতাবেক খলিশাখালীতে অবস্থানরত ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের দখলমুক্ত করার জন্য জেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় পাস হওয়া রেজুলেশনের অনুলিপি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ১৯টি দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেন। এরপর ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দখলদার ভূমিদস্যুদের দখলমুক্ত ও উচ্ছেদ করে খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরটি জমির প্রকৃত মালিকরা ফেরত পান।
খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরের জমি ফেরত পেয়ে মালিকগণ আবারও মাছ চাষ শুরু করেন। মালিকপক্ষ খলিশাখালীর ৪৩৯.২০ একর সম্পত্তি বা জমি শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করাকালীনসময়ে রঘুনাথ খাঁ বেশ কিছুদিন যাবৎ দেবহাটার শিমুলিয়া বাজারে কাজী গোলাম ওয়ারেশের ছেলে ঘের মালিক কাজী সুরুজ ওয়ারেশ এর কাছে মোটা অংকের টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। দাবীকৃত চাঁদার টাকা না দিলে রঘুনাথ খাঁ মিথ্যা সংবাদ প্রকাশসহ নানা ধরনের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে ২৩ জানুয়ারি তারিখে রঘুনাথ খাঁ সহ সন্ত্রাসীরা ঘের দখলের প্রস্তুতিকালে পুলিশের হাতে ককটেল সহ ধরা পরে।

দেবহাটার খলিশাখালীর ঘের মালিকদের একজন কাজী সুরুজ ওয়ারেশ বলেন, “২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রঘুনাথ খাঁ, আনারুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম গাজীরহাট বাজারে আমার অফিসে এসে ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং ২ দিনের মধ্যে তাদের দাবিকৃত টাকা না দিলে ভুমিদস্যুদের দিয়ে তার সকল চিংড়ি ঘের দখল করিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে পরের দিন ২২ জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রঘুনাথ খাঁ দেবহাটা থানাধীন খলিশাখালী গ্রামের সাপমারা খালের ব্রীজের পাশে বসে দখলদার ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের সাথে পরামর্শ করে পুনরায় ঘের দখলের প্রস্তুতি নেন এবং সাপমারা ব্রীজের উপর গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্রীজ উপর দিয়ে জন সাধারণের চলাচল বন্ধ করে দেন। ২৩ জানুয়ারি সোমবার আনুমানিক রাত ৪টার দিকে প্রায় ১০০জন ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি ও সন্ত্রাসীরা গুলি ছুঁড়ে ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরে প্রবেশ করলে ঘের মালিকের পাহারাদাররা ঘের থেকে ভয়ে ও আতঙ্কে পালিয়ে যায়।’

দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ ওবায়দুল্লাহ মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘২৩ জানুয়ারি সোমবার আনুমানিক রাত ৪টার দিকে প্রায় ১০০জন ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ি ও সন্ত্রাসীরা গুলি ছুঁড়ে ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে খলিশাখালীর চিংড়ি ঘেরে প্রবেশ করার ঘটনা জানতে পেরে দেবহাটা থানা পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার জন্য অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থলে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের মৃত মদন মহন খাঁ এর ছেলে রঘুনাথ খাঁ (৫৭), দেবহাটা উপজেলার ঢেপুখালী গ্রামের মৃত ফজর আলী গাজী এর ছেলে রেজাউল করিম (৬৩) ও চালতেতলা গ্রামের নওশের হাওলাদার এর ছেলে মোঃ লুৎফর রহমান (৪৫) কে পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ৫টি ককটেল সহ বিস্ফোরিত ককটেলের অংশ, কাঠের গুড়ি, লাঠিসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। আসামীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে।”

এ ঘটনায় ঘের মালিক কাজী গোলাম ওয়ারেশ এর ছেলে কাজী সুরুজ ওয়ারেশ গ্রেফতারকৃত ৩জনসহ ১৫জন পলাতক এবং ২০/২৫ জন অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামী করে দেবহাটা থানায় ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে এবং ১৯৭৪ সালের দ্য স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং- ০৮, তাং- ২৩জানুয়ারি’ ২০২৩। পরের দিন ২৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে খলিশাখালীর ঘের মালিকগণ গ্রেফতারকৃত আসামী ও সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে বক্তরা বলেন, এই মামলার আসামীরা নানা কারণেই থাকছে ধরা ছোয়ার বাইরে। আসামীদের কাছে প্রশাসনও অসহায়। ফলে মামলার বাদী ও খলিশাখালীর চিংড়ি ঘের মালিকগণ ও স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ কারণে স্থানীয় জনগণ আসামীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন।

পারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু ভীতির সুরে জানান, ‘ওই জমিটি মালিকানা বলেই জানি। কাজী গোলাম ওয়ারেশ ও তাদের শরীকরা ওই জমি দীর্ঘদিন যাবৎ ভোগ দখল করছে। অন্যদের এই জমি দখল দুঃখজনক। এর থেকে বেশি আমি বলতে পারবোনা। ’

এ বিষয়ে জানতে দেবহাটা উপজেলা ভাইস চেয়ারাম্যান হাবিবুর রহমান সবুজের মোবাইলে বার বার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জেলা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান জানান, ন্যায্যতা নিয়ে জমির মাীলকরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে যাচাই বাছাই করা হয়। সর্বশেষ দেখা গেছে মালিকানাধীন জমি একটা দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেট জবর দখল করে ফায়দা লুটতে চায়। ডাকাত, চাঁদাবাজ, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট গুলি-বোমার মুখে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি জবর দখলে রাখতে চায়। আমি সাতক্ষীরায় যোগদান করার পর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। সন্ত্রাসীরা আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবেনা।