ঢাকা ১১:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০২৪, ৮ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কক্সবাজারে ১২ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করেছে রোহিঙ্গারা

দেশের আওয়াজ ডেস্কঃ
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৮:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ৮৪ বার পড়া হয়েছে

কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের প্রায় ১২ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে গত সাড়ে পা্ঁচ বছরে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস হয় এই বনভূমি। বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী এশিয়ান প্রজাতির হাতির অন্যতম আবাসস্থল ছিল উখিয়া টেকনাফের এই বনভূমি। আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে বুনো হাতিরা।

তাই প্রতি বছর লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বুনোহাতি।এতে করে হাতি যেমন মারা পড়ছে তেমনি মানুষ সহ গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটছে আশংকাজনক হারে। উখিয়া কুতুপালং মহাসড়কের পাশে টাঙানো রয়েছে সতর্কতামূলক সাইনবার্ড- ‘বন্যহাতি চলাচলের পথ’। এর ঠিক পেছনেই ছোট বড় গাছপালা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্প। উচু পাহাড়ের কোল কিংবা পাদদেশ, কোথাও পাহাড় কেটে, থরে থরে নির্মাণ করা হয়েছে দুই লাখের বেশি অস্থায়ী ঘর।

স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ-পায়খানা, বিদ্যুৎলাইন, সড়ক, নিষ্কাশন খাল, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়সহ গুদামঘর। জ্বালানির জন্য উজাড় হচ্ছে বন। রুখে দেওয়া হয়েছে সেখানকার ‘আদিবাসী’ বন্যহাতির চলাচল ও বিচরণক্ষেত্র। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই- এসব পাহাড়ে বছর পাঁচেক আগেও ছিল সবুজ অরণ্য এবং হাতির রাজত্ব। বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এ অঞ্চলের প্রায় ১২ হাজার ২০০ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও তিন থেকে চার হাজার একর বনভূমির গাছপালা উজাড় করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জ্বালানি সংগ্রহের জন্য।

কক্সবাজার ও টেকনাফ উপদ্বীপের অন্তর্গত বিশাল পাহাড়ি বনভূমিতে ৫২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যেত, যা স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতির এ সাড়ে পাঁচ বছরে সবকটিই এখন ধ্বংসের পথে।

কক্সবাজার বন বিভাগের (দক্ষিণ) তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে থেকে দেশটির রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, তেলখোলা মোছার খোলা, মক্করারবিল বা হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লা কাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া উনচিপ্রাং ঝিমং খালী, রঙ্গিখালী ও কেরনতলী বন বিভাগের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এতে ধ্বংস হয়েছে ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ৯ হাজার ৮২০ কোটি টাকারও বেশি।

জনপ্রতিনিধিদের দাবী- ক্ষতির পরিমাণটা আরও অনেক বেশি, সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার মতো। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসতে থাকে। নিবন্ধিত মোট ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। এ সংখ্যা গত পা্চ বছরে ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পুরনো দুটি নিবন্ধিত এবং নতুন অনিবন্ধিত ৩২টিসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩৪টি।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সরওয়ার কামাল বলেন, ১২ হাজার ১৬৪ দশমিক ২ একর বনভূমি দখল করে এসব ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, ভূমিরূপ পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজসম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ৯ হাজার ৪৫৭ কোটি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি প্রায় ২ হাজার২৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এতে আরও বলা হয়, ৫৮০ একর সৃজিত বন এবং ১ হাজার ২৫৭ একর প্রাকৃতিক বনসহ ক্যাম্প এলাকার বাইরে জ্বালানি সংগ্রহে রোহিঙ্গারা বনাঞ্চল উজাড় করেছে ১ হাজার ৮৩৫ একর। সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ১২ হাজার একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী কমিটির চার সদস্যকে নিয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা দেখতে পান, রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের ১২ হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।

বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর হামলাও করছে হাতির পাল। গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩ জন।বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, কক্সবাজারের বনাঞ্চলগুলো মূলত এশিয়ান হাতির বিচরণের ঐতিহ্যগত পথ। কিন্তু এ অঞ্চলে রোহিঙ্গা অভিবাসনের কারণে হাতির পাল এক বন থেকে অন্য বনে চলাচলে বাধা পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাধা ভাঙারও চেষ্টা করছে প্রাণীগুলো। তখনই বাধে মানুষ-হাতির সংঘর্ষ। এতে প্রাণও হারাচ্ছেন রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় জনতা। অন্যদিকে হাতিরাও বনে পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে লোকালয়ে হামলে পড়ছে।

প্রকৃতি ও পরিবেশবিদরা বলছেন, হাতি বৃহৎ বন্যপ্রাণী ও শক্তিধর হওয়ায় মানুষের কাছে প্রকৃতি বিনষ্টের প্রতিশোধ নিচ্ছে। হাতি ছাড়াও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু-পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। বিনষ্ট হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, লতা, গুল্ম, বাঁশ, বেত, উলুফুল, ঔষধি গাছ। এসব ক্ষুদ্র বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু ও গাছপালা হাতির মতো এ মুহূর্তে প্রতিশোধ না নিতে পারলেও অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বেশি হুমকিস্বরূপ হবে।

পরিবেশের ওপর প্রভাববিষয়ক ইউএনডিপির এক গবেষণায় উঠে আসে, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় মোট ১১ ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-অতিরিক্ত সংখ্যক টিউবওয়েল স্থাপনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির আধার কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির আধার দূষিত হওয়া। সুপেয় পানির অন্যান্য উৎস, যেমন- সীমিত সংখ্যক নদী ও খাল ইতোমধ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া অতিরিক্ত গাছ কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের কারণে বেশিরভাগ পাহাড়ি ছড়া এখন সারাবছরই পানিশূন্য থাকছে। এতে করে ওই এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদে প্রাকৃতিক সুপেয় খাবার পানির অভাবে পড়তে যাচ্ছে। তা ছাড়া অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে ১৩ লাখের ও বেশি রোহিঙ্গাসহ ১৭ লাখ অধিবাসীর এ অঞ্চল পরিণত হচ্ছে এক কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে।

এসব ক্ষতিকর প্রভাবে অচিরেই এ জনপদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। জমে থাকা এসব বর্জ্যরে বেশিরভাগই বর্ষাকালে পাহাড়ি ছড়া বন্যার পানির স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী নাফ নদীসহ অন্যান্য প্রধান সংযোগ খালে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মৎস্য সম্পদসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর ওপর। অন্যদিকে পাহাড় কেটে ঘর বানানো ও উপরিভাগের মাটি সরিয়ে সমতল করার কারণে বিশাল এলাকার ভূ-প্রকৃতিগত পরিবর্তন হচ্ছে। এতে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া ও মাটি আলগা হয়ে বর্ষাকালে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। পাহাড়ধসে সম্প্রতি ৩ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে এবং ১৪ রোহিঙ্গাসহ ২৭ জনের মৃত্যুও হয়েছে।

বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মধ্যে অবস্থিত হওয়ার পরও এ পাহাড়ি বন্য প্রতিবেশ ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ধস ও বন্যার মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করে দীর্ঘকাল টিকে আছে। রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবিলায় অবশ্য বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ কিছু দেশি-বিদেশি সংস্থা খালি ও পরিত্যক্ত জায়গায় গাছের চারা রোপণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির তুলনায় সেই পদক্ষেপ খুবই নগণ্য।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা) কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এক সময় হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়তো গাছও লাগানো যাবে, কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। আর যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। আর এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের এ ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এমনিতেই বাণিজ্যিক কারণে বিশাল জমি বরাদ্দ দেওয়ায় কক্সবাজারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। ফলে সাগর, পাহাড় আর সবুজ বনাঞ্চলের মধুর মিতালীতে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ শাহীন ইমরান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশগত যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এর ক্ষতিপূরণে ক্যাম্পগুলোতে বৃক্ষরোপণ করেছি।

বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন,‘উখিয়া ও টেকনাফ তথা পুরো কক্সবাজারের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। তবে আমরা পরিবেশের ভারসম্য ফিরিয়ে আনার জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা এনজিওগুলোও আমাদের তত্ত্ববধানে বৃক্ষরোপণ করছেন। আর বন বিভাগের পক্ষ থেকে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে ১৭ লাখ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে।

এর বাইরে স্থানীয়রা বনভূমি উজাড় করে শুধুমাত্র উখিয়ার কুতুপালং,লম্বাশিয়া,বালুখালী,তেলখোলা, মোছারখোলা,থাইংখালী মরাগাছতলা, জামতলী ও শফিউল্লাহ কাটা সহ বিভিন্ন স্থানে বনভূমি দখল করে রোহিঙ্গা মার্কেট বসিয়েছেন। এ ছাড়া উখিয়ার কুতুপালং ফলিয়াপাড়া, পালংখালীতে অফিস, গুদামঘর,ভাড়াবাসা সহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে করেছেন স্থানীয় লোকজন।

এগুলো ভাড়া দেয়া হয়েছে এনজিওর অফিস, গুদামঘর, ও বাসাভাড়া দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। স্থানীয় বন কর্মকর্তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।তাছাড়া এক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতার কথাও অপকটে জানান। বনবিভাগ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয়রা উখিয়াতে এক একরের বেশী বনভূমি হাত ছাড়া হয়েছে।বনভুমি দখলকারী প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোকের বিরুদ্ধে ২৭৮ টি মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

কক্সবাজারে ১২ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করেছে রোহিঙ্গারা

আপডেট সময় : ০৮:৫৮:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের প্রায় ১২ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে গত সাড়ে পা্ঁচ বছরে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস হয় এই বনভূমি। বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী এশিয়ান প্রজাতির হাতির অন্যতম আবাসস্থল ছিল উখিয়া টেকনাফের এই বনভূমি। আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে বুনো হাতিরা।

তাই প্রতি বছর লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বুনোহাতি।এতে করে হাতি যেমন মারা পড়ছে তেমনি মানুষ সহ গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটছে আশংকাজনক হারে। উখিয়া কুতুপালং মহাসড়কের পাশে টাঙানো রয়েছে সতর্কতামূলক সাইনবার্ড- ‘বন্যহাতি চলাচলের পথ’। এর ঠিক পেছনেই ছোট বড় গাছপালা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্প। উচু পাহাড়ের কোল কিংবা পাদদেশ, কোথাও পাহাড় কেটে, থরে থরে নির্মাণ করা হয়েছে দুই লাখের বেশি অস্থায়ী ঘর।

স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ-পায়খানা, বিদ্যুৎলাইন, সড়ক, নিষ্কাশন খাল, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়সহ গুদামঘর। জ্বালানির জন্য উজাড় হচ্ছে বন। রুখে দেওয়া হয়েছে সেখানকার ‘আদিবাসী’ বন্যহাতির চলাচল ও বিচরণক্ষেত্র। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই- এসব পাহাড়ে বছর পাঁচেক আগেও ছিল সবুজ অরণ্য এবং হাতির রাজত্ব। বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এ অঞ্চলের প্রায় ১২ হাজার ২০০ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও তিন থেকে চার হাজার একর বনভূমির গাছপালা উজাড় করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জ্বালানি সংগ্রহের জন্য।

কক্সবাজার ও টেকনাফ উপদ্বীপের অন্তর্গত বিশাল পাহাড়ি বনভূমিতে ৫২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যেত, যা স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতির এ সাড়ে পাঁচ বছরে সবকটিই এখন ধ্বংসের পথে।

কক্সবাজার বন বিভাগের (দক্ষিণ) তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে থেকে দেশটির রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, তেলখোলা মোছার খোলা, মক্করারবিল বা হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লা কাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া উনচিপ্রাং ঝিমং খালী, রঙ্গিখালী ও কেরনতলী বন বিভাগের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এতে ধ্বংস হয়েছে ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ৯ হাজার ৮২০ কোটি টাকারও বেশি।

জনপ্রতিনিধিদের দাবী- ক্ষতির পরিমাণটা আরও অনেক বেশি, সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার মতো। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসতে থাকে। নিবন্ধিত মোট ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। এ সংখ্যা গত পা্চ বছরে ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পুরনো দুটি নিবন্ধিত এবং নতুন অনিবন্ধিত ৩২টিসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩৪টি।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সরওয়ার কামাল বলেন, ১২ হাজার ১৬৪ দশমিক ২ একর বনভূমি দখল করে এসব ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, ভূমিরূপ পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজসম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ৯ হাজার ৪৫৭ কোটি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি প্রায় ২ হাজার২৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এতে আরও বলা হয়, ৫৮০ একর সৃজিত বন এবং ১ হাজার ২৫৭ একর প্রাকৃতিক বনসহ ক্যাম্প এলাকার বাইরে জ্বালানি সংগ্রহে রোহিঙ্গারা বনাঞ্চল উজাড় করেছে ১ হাজার ৮৩৫ একর। সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ১২ হাজার একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী কমিটির চার সদস্যকে নিয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা দেখতে পান, রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের ১২ হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।

বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর হামলাও করছে হাতির পাল। গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩ জন।বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, কক্সবাজারের বনাঞ্চলগুলো মূলত এশিয়ান হাতির বিচরণের ঐতিহ্যগত পথ। কিন্তু এ অঞ্চলে রোহিঙ্গা অভিবাসনের কারণে হাতির পাল এক বন থেকে অন্য বনে চলাচলে বাধা পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাধা ভাঙারও চেষ্টা করছে প্রাণীগুলো। তখনই বাধে মানুষ-হাতির সংঘর্ষ। এতে প্রাণও হারাচ্ছেন রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় জনতা। অন্যদিকে হাতিরাও বনে পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে লোকালয়ে হামলে পড়ছে।

প্রকৃতি ও পরিবেশবিদরা বলছেন, হাতি বৃহৎ বন্যপ্রাণী ও শক্তিধর হওয়ায় মানুষের কাছে প্রকৃতি বিনষ্টের প্রতিশোধ নিচ্ছে। হাতি ছাড়াও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু-পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। বিনষ্ট হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, লতা, গুল্ম, বাঁশ, বেত, উলুফুল, ঔষধি গাছ। এসব ক্ষুদ্র বন্যপ্রাণী, জীবজন্তু ও গাছপালা হাতির মতো এ মুহূর্তে প্রতিশোধ না নিতে পারলেও অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বেশি হুমকিস্বরূপ হবে।

পরিবেশের ওপর প্রভাববিষয়ক ইউএনডিপির এক গবেষণায় উঠে আসে, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় মোট ১১ ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-অতিরিক্ত সংখ্যক টিউবওয়েল স্থাপনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির আধার কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির আধার দূষিত হওয়া। সুপেয় পানির অন্যান্য উৎস, যেমন- সীমিত সংখ্যক নদী ও খাল ইতোমধ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া অতিরিক্ত গাছ কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের কারণে বেশিরভাগ পাহাড়ি ছড়া এখন সারাবছরই পানিশূন্য থাকছে। এতে করে ওই এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণ দীর্ঘমেয়াদে প্রাকৃতিক সুপেয় খাবার পানির অভাবে পড়তে যাচ্ছে। তা ছাড়া অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে ১৩ লাখের ও বেশি রোহিঙ্গাসহ ১৭ লাখ অধিবাসীর এ অঞ্চল পরিণত হচ্ছে এক কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে।

এসব ক্ষতিকর প্রভাবে অচিরেই এ জনপদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। জমে থাকা এসব বর্জ্যরে বেশিরভাগই বর্ষাকালে পাহাড়ি ছড়া বন্যার পানির স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী নাফ নদীসহ অন্যান্য প্রধান সংযোগ খালে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মৎস্য সম্পদসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর ওপর। অন্যদিকে পাহাড় কেটে ঘর বানানো ও উপরিভাগের মাটি সরিয়ে সমতল করার কারণে বিশাল এলাকার ভূ-প্রকৃতিগত পরিবর্তন হচ্ছে। এতে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া ও মাটি আলগা হয়ে বর্ষাকালে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। পাহাড়ধসে সম্প্রতি ৩ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে এবং ১৪ রোহিঙ্গাসহ ২৭ জনের মৃত্যুও হয়েছে।

বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মধ্যে অবস্থিত হওয়ার পরও এ পাহাড়ি বন্য প্রতিবেশ ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ধস ও বন্যার মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করে দীর্ঘকাল টিকে আছে। রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবিলায় অবশ্য বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ কিছু দেশি-বিদেশি সংস্থা খালি ও পরিত্যক্ত জায়গায় গাছের চারা রোপণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির তুলনায় সেই পদক্ষেপ খুবই নগণ্য।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা) কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এক সময় হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়তো গাছও লাগানো যাবে, কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। আর যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। আর এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের এ ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এমনিতেই বাণিজ্যিক কারণে বিশাল জমি বরাদ্দ দেওয়ায় কক্সবাজারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। ফলে সাগর, পাহাড় আর সবুজ বনাঞ্চলের মধুর মিতালীতে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ শাহীন ইমরান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশগত যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এর ক্ষতিপূরণে ক্যাম্পগুলোতে বৃক্ষরোপণ করেছি।

বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন,‘উখিয়া ও টেকনাফ তথা পুরো কক্সবাজারের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। তবে আমরা পরিবেশের ভারসম্য ফিরিয়ে আনার জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা এনজিওগুলোও আমাদের তত্ত্ববধানে বৃক্ষরোপণ করছেন। আর বন বিভাগের পক্ষ থেকে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে ১৭ লাখ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে।

এর বাইরে স্থানীয়রা বনভূমি উজাড় করে শুধুমাত্র উখিয়ার কুতুপালং,লম্বাশিয়া,বালুখালী,তেলখোলা, মোছারখোলা,থাইংখালী মরাগাছতলা, জামতলী ও শফিউল্লাহ কাটা সহ বিভিন্ন স্থানে বনভূমি দখল করে রোহিঙ্গা মার্কেট বসিয়েছেন। এ ছাড়া উখিয়ার কুতুপালং ফলিয়াপাড়া, পালংখালীতে অফিস, গুদামঘর,ভাড়াবাসা সহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে করেছেন স্থানীয় লোকজন।

এগুলো ভাড়া দেয়া হয়েছে এনজিওর অফিস, গুদামঘর, ও বাসাভাড়া দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। স্থানীয় বন কর্মকর্তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।তাছাড়া এক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতার কথাও অপকটে জানান। বনবিভাগ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয়রা উখিয়াতে এক একরের বেশী বনভূমি হাত ছাড়া হয়েছে।বনভুমি দখলকারী প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোকের বিরুদ্ধে ২৭৮ টি মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম।