ইবি ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে র্যাগিংয়ের অভিযোগ
- আপডেট সময় : ১০:১৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১১৪ বার পড়া হয়েছে
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক নবাগত ছাত্রীকে র্যাগিংয়ের অভিযোগ ওঠেছে। শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ও রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে রাত সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় তিনটা পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর।
ভুক্তভোগী ফুলপরি ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। র্যাগিংয়ের সময় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীরা তার বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে রাখেন বলে অভিযোগ তার। পরদিন সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে ভয় পেয়ে হল ছেড়ে বাসায় চলে যান ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী। র্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা দফতর বরাবর লিখিত দিয়েছেন ওই ছাত্রী।
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী বলেন, গত ৮ ফেব্রুয়ারি আমার ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হওয়ার জন্য আমি ৭ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ৩০৬নং রুমে আমার এলাকার (পাবনা) পরিচিত এক আপুর রুমে গেস্ট হিসেবে উঠি। যথাযথভাবে সবাইকে সম্মানপূর্বক রুমে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করি। এরপর ১১ ও ১২ তারিখে দুই দফায় আমি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের আবাসিক ছাত্রী ও পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা আপুর নেতৃত্বে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০- ২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী তাবাচ্ছুম আপুসহ নাম না জানা আরও অন্তত ৭-৮ জন দ্বারা র্যাগিংয়ের নামে চরমভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হই। আমাকে বিবস্ত্র করে আমার গোপন ভিডিও ধারণ করে রাখেন। এমনকি তারা আমাকে জীবননাশের হুমকিও দেন।
ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, গত ৯ ফেব্রুয়ারি আমাকে ডিপার্টমেন্টের ২০২০-২১ এর তাবাসসুম নামের ওই সিনিয়র আপুর রুমে দেখা করতে বলা হয়। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে আপুর রুমে যেতে পারিনি। এরপর থেকেই তারা আমার উপর চড়াও হতে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের রুমে গেলে আমার সাথে খারাপ আচরণ করেন, ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন এবং হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। তারা অভিযোগ করতে থাকেন, তাদের না জানিয়ে কেন হলে উঠেছি। অথচ হলে আমি আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, গেস্ট হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য ওই রুমে উঠেছিলাম। কিন্তু প্রথম দফায় শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাতে আমার উপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। পরে গত রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকেল আনুমানিক চারটার সময় হল প্রভোস্ট এবং সহকারী প্রক্টোরের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মীমাংসা হয়। কিন্তু রাত না পেরোতেই রোববার দিবাগত রাত আনুমানিক ১১টার সময় অন্তরা আপুসহ ৭-৮ জন আমাকে একটি গণরুমে নিয়ে যান এবং রুমে নিয়ে গিয়ে কথায় কথায় ওনারা ৭-৮ জন মিলে এলোপাতাড়িভাবে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। আপু, আপনারা আমাকে কেন মারছেন বলতে গেলে উনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন- ‘চিনিস আমাদের! আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস তুই? কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর?’ আমি তখন কান্না করে বলি- আপু আমাকে আর মাইরেন না। উনাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা পা দিয়ে লাথি মারেন। আর অকথ্য ভাষায় আমাকে ও আমার মা-বাবাকে নিয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এরপর আমার বুকের উপর হাত দিয়ে জোর করে থাবা মারেন এবং গামছা দিয়ে আমার গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখেন আর ছাড়ে। আর বলতে থাকেন- যা বলবো একটা কথাও যেন বাইরে না যায়। একপর্যায়ে তারা একটা ময়লা গ্লাস আমাকে দিয়ে চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেয় এবং সেটার ভিডিও ধারণ করে। তারপর তারা বলতে থাকেন- জামা খোল, আমি জামা খুলতে না চাইলে তারা আমাকে আবার মারা শুরু করেন এবং আমার জামা খুলে জোর করে আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওগুলো তাদের কাছে সংরক্ষণ করা আছে। তারপর আমাকে বলেন, যদি বাইরের কাউকে একথা বলিস, তাহলে তোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিবো। যাতে তুই কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস। অন্তরা আপু বলেন, তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো, যা বলেছি তা মনে থাকে যেন!
ওই ছাত্রী অভিযোগে উল্লেখ করেন, টর্চার শেষে রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার পর আমাকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেন। আর সবাই বলেন- মুখ খুললেই কিন্তু খবর খারাপ হয়ে যাবে। পরদিন সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) খুব সকালে জীবন বাঁচাতে আমি হল থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি পাবনাতে চলে যাই। তারপর সকালে আমাকে হলে না পেয়ে অন্তরা আপুসহ ওই ৭-৮ জন সবাই আমাকে একাধিকবার ফোন দেন, কিন্তু ভয়ে আমি কারো ফোনই রিসিভ করিনি। পরে আমি বাসায় এসে আমার পরিবারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ওই ছাত্রীর সঙ্গে এরকম কোনো কিছু ঘটেনি। ওই ছাত্রীর পরিচিত এক ভাই ফোন দিয়ে আমাকে তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়।’
ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টি খোঁজখবর নেওয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট প্রফেসর ড. শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষের এক মেয়ে কিছু সিনিয়রদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে বলে অভিযোগ করেছিল কিছু ছাত্রী। পরে আমি ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা মিলে বিষয়টি মিটমাট করে দিই। কিন্তু পরে তার সাথে কী হয়েছে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা হল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
এ বিষয়ে ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. শেলীনা নাসরিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে বরাবরই জিরো টলারেন্স। ওই ছাত্রীর বিষয়টি শুনেছি। তবে এখনও লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এবিষয়ে প্রক্টর প্রফেসর ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিষয়টি জেনেছি। উভয়ের পক্ষের কথা শুনে বিষয়টি যাচাই বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি প্রফেসর ড. শেখ আবদুস সালাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘র্যাগিংয়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। র্যাগিং তো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও র্যাগিং ছিল না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়গুলো অ্যালাউ করে না। সংশ্লিষ্টদের সাথে বসে বিষয়টি বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’