কৃষিতে স্বনির্ভর দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও। এখানকার মাটি উর্বর হওয়ায় অন্যান্য জেলার তুলনায় যেকোনো ফসল উৎপাদন হয় বেশি। ঠাকুরগাঁওয়ে এবার গতবারের থেকে বেশি পাটের উৎপাদন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পাট চাষ হলেও দাম কম হওয়ায় কৃষকেরা হতাশায় পড়েছেন। লাভের আশায় অধিক খরচ করে পাট চাষ করে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় তারা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
এক সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাটক্রয় কেন্দ্র ছিল, আবার বড় বড় জুট মিলের চাহিদা পূরণে কৃষকরা পাট চাষে ব্যাপকভাবে লাভবান হতেন। অপরদিকে, ক্রয় কেন্দ্রগুলো পাট সংগ্রহ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করত। ফলে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির আশা নিয়ে কৃষকরাও ব্যাপকহারে পাট চাষে করতেন।
এদিকে, পাট ক্রয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং এর উৎপাদন খরচসহ যাবতীয় খরচ বেড়ে যাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকেরা।
ঠাকুরগাঁও জেলায় পাট ক্রয় করার মতো সরকারী সব কেন্দ্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এক সময় এখানে সদর উপজেলার শিবগঞ্জ এলাকায় প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস এবং রুহিয়ার আদমজী জুট মিলস গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে এ কেন্দ্র দুটি বন্ধ হয়ে যায়।
ঠাকুরগাঁওয়ে এবার পাটের উৎপাদন ব্যাপক হলেও জাগ দেওয়া নিয়ে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। বর্ষার এ ভারি মৌসুমেও ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি দেখা যায়নি এখানে। এর অভাবে পাট ভালো করে জাগ দিতে পারেনি কৃষকেরা। এতে সময়মতো পাট জাগ দিতে না পারায় পাটের আঁশ ভালো মানের হয়নি।
গত ৭ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খচাবাড়ি হাটে গিয়ে দেখা যায়, হাটটিতে জমজমাট পাটের বাজার বসেছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার অনেক এলাকার পাট চাষিরা সাইকেল ও ভ্যানে করে পাট বিক্রি করতে এসেছেন। ভালো মানের প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ এবং সর্বনিম্ন ১ হাজার ৯০০ টাকায়।
এদিকে, হাটে পাট বিক্রি করতে এসে উপজেলার মিলনপুর গ্রামের আবুল কালাম বলেন, ৫০ শতক জমিতে পাটের আবাদ করেছিলাম। খরার কারণে এবার পাটের তেমন ভালো ফলন হয়নি। গতবার একই পরিমাণ জমিতে যেখানে ১৪ মণ পাট পেয়েছিলাম, এবার সেখানে পাট পেয়েছি মাত্র ১০ মণ। এছাড়া দামও গতবারের চেয়ে অনেক কম। ৫০ শতক জমিতে পাট চাষে প্রায় ২২ হাজার টাকা খরচ পড়েছে। ২ হাজার টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করে লাভ তো দূরে থাক, খরচই উঠবে না। পাট চাষ করা এখন আমাদের কাছে গলার কাঁটার মতো হয়ে গেছে।
পাট চাষি ইয়াছিন আলীর বলেন, দুই বিঘা জমি তৈরিতে তিনবার চাষ করেছি। এর জন্য বীজ-সার ও কীটনাশক, নিড়ানি-পরিচর্যা, কাটা ও জাগ, পাট জাগ দিতে পুকুর ভাড়া, আঁশ ছাড়ানো, পরিবহন ও অন্যান্য খরচসহ মোট ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন পাট বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ২২ থেকে ২৩ শত টাকায়। এতে খরচ উঠবে কী না সন্দেহ! বৃষ্টির অভাবে সঠিক সময়ে জাগ দিতে না পারায় পাটের রং ভালো হয়নি।
স্থানীয় কৃষক আবদুল মালেক বলেন, বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না হওয়ায় পাট জাগ দিতে বিপাকে পড়ছেন তারা। এ বছর পাটের উৎপাদন খরচ বিঘাপ্রতি হয়েছে ২০ হাজার টাকার মতো, আর ফলন হয়েছে ৭ থেকে ৮ মণ। বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৬ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকায়। চাষিদের বিঘাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা। আর জমি লিজ নেওয়া পাট চাষিদের বিঘাপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে লোকসান।
পাট ব্যবসায়ী আনোয়ার বলেন, এ বছর এলাকায় ভালো মানের পাটের উৎপাদন খুবই কম হয়েছে। তাই মিলে চাহিদা কম থাকায় দাম কম পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি মণ পাট মান অনুপাতে ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০০ টাকায় কেনা হচ্ছে।
এদিকে, গড়েয়া হাটে পাট বিক্রি করতে আসা কবির আলী বলেন, কৃষকেরা পাট চাষ করে বিপদে পড়েছেন। ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় সোনালি আঁশে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। সেইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকদের জীবনযাপনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এ ক্ষেত্রে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে ভর্তুকির দাবি জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় জেলায় এবার পাটের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে জেলায় পাটের আবাদ হয়েছিল ৬ হাজার ৮১৭ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ২৪৪ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থ বছরে আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৮১২ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৭৮৪ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আবাদ হয়েছিল ৭ হাজার ৭২৫ হেক্টর ও উৎপাদন হয় প্রায় ১৪ হাজার ৮০ মেট্রিক টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৯০০ হেক্টর। এছাড়া হেক্টর প্রতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন পাট।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার পাটের আবাদ বেশি হয়েছে। বর্তমান পাটের বাজার দর ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা। পানির স্বল্পতার জন্য আমরা চাষিদের রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট জাগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। পাটের আবাদ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় পাটের উচ্চ ফলনশীল বীজ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। পাটের আবাদ বৃদ্ধিতে সরকারের যে সার্বিক উদ্যোগ, তাতে আমরা মনে করি- আগামীতে আবাদ আরও বৃদ্ধি পাবে।