মিয়ানমারের টালবাহানা আর রোহিঙ্গাদের শর্তের গ্যাড়াকলে আটকে আছে প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গা সংকটের ৬ বছর পার হতে চললেও প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। শুধুমাত্র ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করে দায় সারছেন বিদেশি প্রতিনিধিরা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তাও কমছে আশঙ্কাজনক হারে। যার কারণে নানামুখী সংকটসহ অস্থিরতা বাড়ছে কক্সবাজার অঞ্চলে। আর গেলো ৬ বছরে ক্যাম্পে নতুন করে জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার শিশু। তবে এই সংকটের জন্য মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাদেরকে দুষছেন প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্টরা।
মোহাম্মদ জোবায়ের, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর তার সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। স্বদেশে ফিরতে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সবসময় চালিয়ে যান আলাপ-আলোচনা। একই সঙ্গে বিদেশি প্রতিনিধি দল আসলেই ছুটে যান তাদের কাছে আর হাতে দেন দাবি-দাওয়া সম্বলিত চিঠি। জোবায়েরের দাবি, বিদেশি প্রতিনিধিরা আসে আর যায়, আশ্বস্তও করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি ৬ বছরেও।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “ছয় বছর পার হচ্ছে, পরের দেশে এই দীর্ঘ বছর জীবন যাপন আমরা করতে চাই না। বাংলাদেশের মানুষ আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সহায়তা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেশি, আমরা তাদেরকে আর কষ্ট দিতে চাই না। আমরা দ্রুত নিজদেশ মিয়ানমার ফিরে যেতে চাই।”
মোহাম্মদ জোবায়ের আরও বলেন, “আমরা দেশ ছাড়া মানুষ নয়, আমাদের দেশ আছে। মিয়ানমারই হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি। এখন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে একটায় দাবি, দ্রুত স্বদেশ মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, নাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে যাতে ফেরত পাঠায়।”
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এরপর দু’বার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু মিয়ানমারের অনীহায় তা ভেস্তে যায়। এরপর করোনা ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের কারণে দীর্ঘসময় বন্ধ থাকে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা।
“চলতি বছরে চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। যার জন্য চলতি বছরের ১৫ মার্চ রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করতে টেকনাফ আসে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলটি এক সপ্তাহ টেকনাফে অবস্থান করে কয়েক’শ রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমারে ফিরে যায়।
“এরপর ৫ মে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সার্বিক পরিস্থিতি কতটা অনুকূলে তা দেখতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে যায় ২০ জন রোহিঙ্গা নাগরিকসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। তারপর প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের রাজি করাতে ২৫ মে ফের মিয়ানমার প্রতিনিধি দল আসে টেকনাফে। তারপর কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিয়ানমারে ফিরে যায় প্রতিনিধি দলটি।”
ফলে প্রত্যাবাসনের জন্য নেয়া পালইট প্রকল্পটিরও অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গাদের শর্ত আর মিয়ানমারের অনীহার কারণে প্রত্যাবাসনের এ উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি।
টেকনাফ শালবাগান ক্যাম্পের বাসিন্দা ছুরুত আলম বলেন, আমরা আমাদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। অবশ্যই আমরা ফিরে যাব। শুধুমাত্র আমাদের নাগরিকত্ব ও নিজ ভিটে মাটি ফিরিয়ে দিতে হবে।
টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা ছৈয়দ হোসাইন বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছি ৬ বছর হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার যদি আমাদের মেনে নেয়, নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিলে শতভাগ আমরা নিজদেশ মিয়ানমারে ফিরতে রাজি আছি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে উজাড় হয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের ১০ হাজার একর বনভূমি। ধ্বংস হয়েছে পাহাড়, গাছপালা, স্থানীয় কৃষি জমি, বন্যপ্রাণি হারিয়েছে আবাসস্থল। হুমকি মুখে জীব-বৈচিত্র্য। রোহিঙ্গাদের অবস্থান যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে ততই বাড়ছে অস্থিরতা। নানামুখী সংকট তৈরি হচ্ছে কক্সবাজার অঞ্চলে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপরাধে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ২০টি। আর এসব মামলায় আসামি সংখ্যা ৬ হাজার ৮’শ ৩৭ জন। যার মধ্যে ২৩৮টি অস্ত্র মামলায় আসামির সংখ্যা ৫৫২ জন, ২ হাজার ৫৭টি মাদক মামলায় আসামির সংখ্যা ২৯৭৯ জন, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টায় মামলায় আসামির সংখ্যা ১৪৪টি, ৪২টি ফরেনার্স এ্যাক্ট মামলায় আসামির সংখ্যা ১০৪ জন, ৪৪টি অপহরণ মামলায় আসামির সংখ্যা ২২২ জন, ৬৫টি বিশেষ ক্ষমতা আইন মামলায় আসামির সংখ্যা ১৩৩ জন, ৭টি পুলিশ আক্রান্ত মামলায় আসামির সংখ্যা ৭৭ জন, ৬২টি ডাকাতি ও ডাকাতি প্রস্তুতি মামলায় আসামির সংখ্যা ৫০৫ জন, ১৩১টি হত্যা মামলায় আমাসির সংখ্যা ৯৯১ জন, ৩৭টি মানবপাচার মামলায় আসামির সংখ্যা ১৮৯ জন ও ২৪৩টি অন্যান্য মামলায় আসামির সংখ্যা ৯৪১ জন।
গেলো ৬ বছরে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, মাদক সহ নানাবিধ অপরাধে। আর সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সহায়তাও আশঙ্কাজনক হারে কমায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার মাত্রা আরও বাড়ছে। যার কারণে স্থানীয়রাও সবসময় থাকেন আতংকে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের এলাকায় এসে স্থানীয়দের খুন করছে। অস্ত্রবাজি, মাদক, অপহরণ থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করছে না।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের বলেন, দিন যতই গড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা বাড়ছে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হচ্ছে। আইন-প্রয়োগকারি সংস্থা সেখানে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও তাদের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। প্রতিদিনই অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যারা নেতৃত্বে রয়েছে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের কোন দুর্বলতা নেই। প্রস্তুতিরও অভাব নেই। কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের যে ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা কখনো মিয়ানমারের সে প্রস্তুতি ছিল না। ২০১৮ সালে সকল রোহিঙ্গার পরিবারভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারকে হস্তান্তর করি। কিন্তু ৬ বছর হতে চললো সেই ডাটাবেজের এখন পর্যন্ত যাচাই-বাছাই শেষ করেনি। গুটিকয়েক মাত্র ৫৬ হাজারের মতো সম্পন্ন করেছে।
মো. মিজানুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের যে আন্তর্জাতিক সহায়তা সেটি অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সহায়তা হিসেবে মাথাপিছু ১২ ডলার দিত, সেটি এবছরের মার্চ মাসে এসে ১০ ডলার এবং জুনে এসে সেটি আরও কমিয়ে ৮ ডলার করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই সহায়তা আরও কমে যাবে। এতে করে প্রকৃত পক্ষে রোহিঙ্গাদের সার্বিক দুর্গতি আরও বাড়বে। তাদের পুষ্টিহীনতা বাড়বে। তাদের বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে এবং খাদ্যের সংকট দেখা দিলে যে ধরনের নেতিবাচক প্রভাব জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ে তা আমরা সবগুলো দেখতে পাচ্ছি।
কমিশনার মো. মিজানুর রহমান আরও বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য তারপরও আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মিয়ানমার থেকে সাড়া পাচ্ছি যে, তারা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে স্ব-স্ব ভিটেতে সেখানে নিয়ে যেতে নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। মিয়ানমার বলছে, অন্তত দক্ষিণ মংডু থেকে যারা ফেরত এসেছে তাদের সেখানে ফেরত দেবে। কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে এনিয়ে দু’দেশের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হচ্ছে। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে গেছে সেটি সঠিক নয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান, এটি জটিল প্রক্রিয়া, যা ৬ বছর ধরে আটকে আছে। কিন্তু আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি এবং মনে করছি, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই হয় তো বহুল প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।