গত বৃহস্পতিবার থেকে ভারি বর্ষণে টানা চতুর্থ দিনের মতো পানিতে ভাসছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। অভিজাত এলাকা খুলশি ও বায়েজীদের মতো উঁচু পাহাড়ি এলাকা ছাড়া গত চারদিন ধরে নগরীর কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুক সমান পানি। এ অবস্থায় ছিন্নমূল মানুষ পড়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। এছাড়া ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল নিয়ে চরম দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ।
সোমবার (০৭ আগস্ট) নগরীর পানিবন্দি কয়েকটি এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে এই দুর্ভোগের কথা জানা গেছে।
নগরীর চকবাজার ফুলতল এলাকার বাসিন্দা মো. মনজুরুল ইসলাম বলেন, চারদিন ধরে আমরা পানিতে আটকা। শুরুতে দুইদিন বিকেলে পানি কমেছিল একটু। রোববার থেকে পানি আবার বেড়ে গেছে। ঘরের মধ্যে এখন হাঁটু পানি। চুলায় আগুন জ্বালাতে পারছি না। কিভাবে আছি, ছেলেমেয়ে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া কিভাবে করছি, সেটা আমরাই শুধু জানি। এভাবে আর কতদিন? কষ্টেরও তো একটা সীমা আছে।
টানা চারদিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে নগরীর চক সুপার মার্কেট। সোমবার দুপুরে দেখা যায়, এই বিপণি কেন্দ্রের নিচতলার সব দোকান বন্ধ। সেখানে হাঁটু সমান পানি জমে আছে। তবে দুপুরের দিকে কাপাসগোলা, বাদুরতলা, কাতালগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় পানি সকালের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। কিন্তু বিকেলের দিকে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় সেখানে কোমর সমান পানি জমে যায়।
বাদুরতলা মাজার গেইট এলাকার বাসিন্দা আবু জাফর বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাতে দিনে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ভাসছি। চুলায় রান্না করতে পারছি না। বাজারে যেতে পারছি না। ঘরে খাবার নাই। ওয়াসার পানি আসছে নোংরা। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকটেও পড়েছি। এ যেন নরক যন্ত্রণায় ভুগছি।
নগরীর মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা খাইরুজ্জামান লিটন মুঠোফোনে বলেন, গত চারদিন ধরে আমরা পানিবন্দি। ঘরে খাবার নাই। পানি নাই। কেউ একটু খোঁজ পর্যন্ত নিতে আসেনি। এভাবে আর দুইদিন থাকলে তো পরিবারের সবাই মারা পড়ব।
এমন অবস্থায় আবহাওয়া অধিদফতরও কোনো সুখবর দিতে পারেনি। মৌসুমী বায়ু প্রবল থাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও চট্টগ্রামে অতি ভারি বর্ষণের আভাস দিয়েছে পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদফতর।
অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ উজ্জল কান্তি পাল বলেন, দুই দিনে চট্টগ্রামে মোট ৪৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। বৃষ্টি আরও দুদিন থাকবে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টি শুরু হয়। রাতভর টানা বৃষ্টির পর শুক্রবার সকালে জোয়ার শুরু হলে নগরীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। শনিবার সকাল ও দুপুরেও জলাবদ্ধতা ছিল। এরপর শনিবার আবারও রাতভর তুমুল বর্ষণে নগরীর নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যায়।
রোববার বেলা ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এদিন চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, চকবাজার, ফুলতল, চেয়ারম্যান ঘাটা, কে বি আমান আলী সড়ক, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, কাতালগঞ্জ, আরাকান রোড, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, ডিসি রোড, হালিশহরের কয়েকটি এলাকা, সল্টগোলা-ইপিজেড সড়ক, বড়পোলসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর, এমনকি বুক সমান পানি জমে যায়।
ওইদিন দুপুর থেকে নগরীতে নতুন কওে চান্দগাঁও শমসেরপাড়া, ঈশান মিস্ত্রির হাট, অক্সিজেন মোড়, মৌলভি পুকুর পাড়, আনন্দবাজার, হালিশহরের এল ব্লক, পুলিশ লাইন, শাপলা আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ ও হাজীপাড়া এলাকায় পানি বাড়তে থাকে।
এরপর বিকেলে টানা মুষলধারে বৃষ্টিতে আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, মুহুরী পাড়া, ব্যাপারি পাড়া, মিস্ত্রি পাড়া এবং হালিশহরের বিভিন্ন ব্লকের নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যেতে থাকে। সন্ধ্যার পর কিছুটা বিরতি দিয়ে রাত ১০টার পর থেকে আবার ভারি বর্ষণ শুরু হয়। রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় জোয়ার। এই জোয়ারের সময়ে আগ্রাবাদ ও হালিশহরের বেশিরভাগ এলাকা ডুবে যায়।
সোমবার সকালে বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, কাপাসগোলা এলাকায় পানি ছিল রোববারের তুলনায় কম। তবে আগ্রাবাদ ও হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায় ছিল হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি।
নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, শুক্রবার দুপুর থেকে এলাকায় পানি ঢুকেছে। নিচতলার প্রায় পুরোটা পানির নিচে। পানির মোটর থেকে শুরু করে সবকিছু তলিয়ে গেছে। এখন খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছি।
সিটি করপোরেশন পরিচালিত চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী মো. আলম বলেন, গত চারদিন ধরে মার্কেটের ভেতর পানি থই থই করছে। অনেক দোকানের কাপড় চোপড় ভিজে নষ্ট হয়েছে। মার্কেটে কেনাকাটা নেই বললেই চলে।
নগরীর চান্দগাঁও এলাকার সমশের পাড়া ছিন্নমূল বস্তির বাসিন্দা ছানোয়ার হোসেন বলেন, বস্তির দেড় হাজার ঘর গত চারদিন ধরে পানির নিচে। চুলায় কারো আগুন জ্বলছে না। খাবার সংকটের সাথে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জীবন রক্ষায় একরকম যুদ্ধ করছি।
সাগর উত্তাল
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, শ্রাবণের শেষ সময়ে চট্টগ্রামে এবার গত ৩০ বছরের চেয়ে রেকর্ড পারিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আরও দুইদিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। মৌসুমি বাযুর প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া পূর্বাভাস কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সাগর উত্তাল রয়েছে। এর প্রভাবে পাহাড় ধসেরও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আগামী পরশু থেকে আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হবে। এরপর ধীরে ধীরে বৃষ্টিপাতও কমে আসবে।
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. খাইরুজ্জামান বলেন, পাহাড় ধসের সতর্কবার্তায় শনি ও রোববার চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়গুলো থেকে ৮০০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।