• বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:৪৪ অপরাহ্ন
  • Arabic AR Bengali BN English EN French FR German DE

বিদেশে উচ্চশিক্ষার অর্থ যাচ্ছে হুন্ডির দখলে!

দেশের আওয়াজ ডেস্কঃ / ১৪ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশ : সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দেশের আলোচিত ইস্যুগুলোর একটি রিজার্ভ সঙ্কট। আলোচনায় রয়েছে দেশ থেকে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নামও। বলা হচ্ছে, মূলত হুন্ডির মাধ্যমেই বিদেশ থেকে টাকা আসছে। আবার দেশ থেকেও বিদেশে টাকা যাচ্ছে অবৈধ এই পথেই।

জানা গেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র টাকাও যাচ্ছে হুন্ডিতেই। যদিও এর প্রধান কারণ হিসেবে সামনে দাঁড় করানো হচ্ছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। বলা হচ্ছে— প্রায় তিন মাস আগে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ করে দেয় দেশীয় ব্যাংকগুলো। এতে বিপদে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। বিদেশে উচ্চশিক্ষারত সন্তানের টিউশন ফি এবং আনুষাঙ্গিক খরচের টাকা পাঠাতে বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে হয়েছে হুন্ডিকে। অভিভাবকদের দাবি— অনেকটা বাধ্য হয়েই এই পথ অবলম্বন করতে হয়েছে তাদের।

বহ্নি আক্তার (ছদ্ম নাম) একজন অভিভাবক। গত বছরের মাঝামাঝিতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন তার ছেলে। সে সময় একটি বেসরকারি ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলেছেন তিনি। এর মাধ্যমেই ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং অন্যান্য খরচ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে তারা আর ব্যাংকিং চ্যানেলে ছেলের কাছে পড়াশোনার খরচ পাঠাতে পারছেন না।

বহ্নি বলেন, প্রতিমাসে ছেলের বাসা ভাড়া, যাতায়াত ও খাবারের টাকা পাঠাতে হয়। ছয়মাসে একবার সেমিস্টার ফি দিতে হয়। আগে তো সহজেই ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা এদিকে পড়েছি বিপদে, আর আমার ছেলে ওদিকে আছে বিপদে। ‘বাধ্য হয়ে হুন্ডিকে বেছে নিতে হয়েছে।’
গেল বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে বাধ্য হয়ে বহ্নি তার ছেলের মাসের খরচ পাঠাচ্ছেন হুন্ডি বা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। এই অভিভাবক আরও বলেন, ‘ছেলের খরচ তো পাঠাতে হবে। এখন খরচ একটু বেশি হলেও হুন্ডি করে টাকা পাঠানো শুরু করেছি।’

শুধু বহ্নি আক্তার নন, একই সমস্যায় ভুগছেন আরও শতাধিক অভিভাবক। সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ পাঠাতে বাধ্য হয়ে হুন্ডির মতো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সংকট যেভাবে গভীর হয়েছে
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ করে দেয় দেশীয় ব্যাংকগুলো। এর জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে সামনে দাঁড় করানো হয় ডলার সংকটকে। বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না দিলেও ব্যাংকগুলো বলছে— ডলার সংকটের কারণে স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে পারছে না তারা।

গেল নভেম্বরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সমিতি অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী মাশরুর আরেফিন বলেছিলেন, ডলার সংকটের কারণে নতুন স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেছিলেন, আপনারা জানেন ডলারের একটা সংকট চলছে। আমাদের ব্যাংকে রেমিটেন্স এবং এক্সপোর্ট থেকে যে ডলার আসে সেই ইনফ্লোর চেয়ে আউটফ্লো বেশি। এটা সাময়িক একটা সমস্যা আমরা শিগগিরই এটা কাটিয়ে উঠবো।
এদিকে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি ফি, টিউশন ফি তো পাঠাতে পারছেনই না বরং বর্তমানে যা বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থী রয়েছেন তারাও দেশ থেকে খরচ নিতে পারছেন না।

অভিভাবকদের ভোগান্তি
যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন নাজমা আক্তারের মেয়ে। কিন্তু দেশীয় ব্যাংকগুলোর কড়াকড়িতে টিউশন ফি পাঠাতে পারেননি ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাধ্য হয়ে লন্ডনে থাকেন এমন পরিচিত একজনের বাংলাদেশে থাকা পরিবারকে তারা নগদ টাকা দিয়েছেন। পরে লন্ডনে থাকা ওই ব্যক্তি তার মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে টিউশন ফি জমা দিয়েছেন। এর ফলে কেবল ভোগান্তিই নয়, বরং তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকাও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হলে প্রতি ডলার কিনতে হতো ১০৮ টাকা হারে। কিন্তু হুন্ডিতে সেটা কিনতে হয়েছে ১১৪ টাকা দরে। তারপরেও তারা বাধ্য হয়ে সন্তানের জন্য হুন্ডি ব্যবহার করে ডলার পাঠিয়েছেন।

সাধারণত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনেচ্ছু একজন শিক্ষার্থী শুরুতে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার ডলার পাঠিয়ে থাকে। প্রতি ছয় মাস পরপর তাদের ১০ হাজার করে ডলার পাঠাতে হয়। এছাড়া মাসিক থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের জন্য গড়ে দুই থেকে চার হাজার ডলার পাঠাতে হয় অভিভাবকদের।
বাংলাদেশে সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চ সেমিস্টারে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে যায়। অভিভাবকেরা বলছেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা নিতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ইমেইল করে, পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে অনুরোধ করার পর কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান টাকা নিতে রাজি হচ্ছে।

বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলছেন, প্রধান কার্যালয় থেকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে মানা করা হয়েছে। যেসব ফাইল এখন খোলা আছে, এমনকি সেগুলো ব্যবহার করেও ডলার পাঠানো বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেন, এলসি পেমেন্টের জন্যই তো আমরা ডলার দিতে পারছি না। এখন স্টুডেন্টদের জন্য কীভাবে দেবো?

বেসরকারি ওই ব্যাংকের একটি শাখার ব্যবস্থাপক পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা বলেন, অনেক গ্রাহক এসে অনুরোধ করছেন, কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। শুনেছি অনেকে বিকল্প নানা ব্যবস্থা করছেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংর্কাস বাংলাদেশের সদস্য ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু এখনো স্টুডেন্ট ফাইল পুরোপুরি আগের মতো একেবারে ওপেন করে দেওয়ার অবস্থা হয়নি। তবে কোনো কোনো ব্যাংক এখন খুলছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরেকটু সময় লাগবে। আশা করা যায়, হয়তো এপ্রিলের পর পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হবে।
উচ্চশিক্ষার অর্থ কি দখল করে নিচ্ছে হুন্ডি?
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২১ শুধু যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৮ হাজারের বেশি।

এছাড়া মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে যান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ থেকে ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছিল।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত শুক্রবার। সভায় বক্তারা বলেছেন, দেশে ও প্রবাসে অবৈধ অর্থ পাচারকারীদের কারণে হুন্ডির বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। কারণ বৈদেশিক আয়ের ৪৯ শতাংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। তাদের মতে— অর্থ-পাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেন।
অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, এতদিন চিকিৎসা ও অর্থ পাচারের মতো কিছু খাতে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হতো।

এতদিন উচ্চশিক্ষার খরচ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমেই পাঠানো হতো। কিন্তু গত তিন মাস নানা বিধিনিষেধের কারণে এখন সে ক্ষেত্রটিও চলে যাচ্ছে হুন্ডির দখলে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে— উচ্চশিক্ষার জন্য স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে সমস্যায় পড়লে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরও কয়েকটি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কখনোই স্টুডেন্ট ফাইল বন্ধ করতে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়নি। হয়তো কোনো ব্যাংকে ডলার সংকট থাকলে সেই ব্যাংক স্টুডেন্ট ফাইল খুলছে না। কিন্তু সব ব্যাংকের অবস্থা তো আর একরকম না। আমরা বরং অভিভাবকদের পরামর্শ দেবো, কোনো ব্যাংকে এরকম সমস্যায় পড়লে অন্য ব্যাংকে যোগাযোগ করা উচিত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ