ঢাকা ০৯:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাভাবনা’

মনিকা পারভীন//
  • আপডেট সময় : ১০:১৪:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জুলাই ২০২৪ ১২০ বার পড়া হয়েছে

শিক্ষা- মনের বন্ধ দরোজাগুলো উন্মোচন করে, আচরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে সত্যিকার মানুষ তৈরি করে। আধুনিক ,স্মার্ট ও সভ্য জাতির এগিয়ে যাওয়ার মূল নির্দেশিকা হলো গুনগত শিক্ষা। জীবন আলোকিত করার পাশাপাশি অভিষ্ঠ উন্নয়ন লক্ষ্য ( SDG) পূরণে শিক্ষা অন্যতম অবলম্বন। মেধা- মননে আধুনিক ও চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই পারে একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে সরকারের একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার প্রথম সোপান। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষার দর্শন ও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা একই সুতোয় গাঁথা। তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন, যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষাই শিক্ষার মূল ভিত্তি। তাই এই শিক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি প্রেস নোটের মাধ্যমে জানানো হয় যে, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে। বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং তারই সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। বর্তমানে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিক্ষানুরাগী। তিনি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তিমূল। বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও দর্শনকে ধারণ করে যেকোনো জাতি একটি আধুনিক কর্মমুখী এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর যে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা যাবে এবং সোনার বাংলা বিনির্মাণ সহজতর হবে। দক্ষ মানব সম্পদ বা সোনার বাংলা গড়তে আমাদের শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। আর এই শিক্ষার ভিতই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা দর্শন অনুসরণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ৩৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নং অভীষ্ট হলো মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমাজতান্ত্রিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা।) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নে দক্ষ জনসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপ-খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৪.৫ ও ৩.৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ ০.৯২ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে ২ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। : ভিশন-৪১ নির্বাচনী ইশতেহার এবং নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মনিটরিং এবং মেন্টরিংয়ের কয়েকটি আকর্ষণীয় দিক হতে পারে:
১. *ডিজিটাল মনিটরিং* – *ই-মনিটরিং সিস্টেম:* শিক্ষার অগ্রগতি ট্র্যাক করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা, যেমন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, মূল্যায়ন, এবং শিক্ষকের কর্মক্ষমতা। – *অনলাইন ড্যাশবোর্ড:* শিক্ষকদের, অভিভাবকদের, এবং প্রশাসকদের জন্য একটি ড্যাশবোর্ড, যেখানে তারা শিক্ষার বিভিন্ন সূচকের তথ্য দেখতে পারে।
২. *নিরীক্ষণ সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি* – *স্মার্ট ক্লাসরুম:* শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সিসিটিভি, ইন্টারেক্টিভ বোর্ড, এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার। – *ডেটা অ্যানালিটিক্স:* শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স এবং উপস্থিতির ডেটা বিশ্লেষণ করে সমস্যাগুলি সনাক্ত এবং সমাধান করা।
৩. *পারফরম্যান্স মূল্যায়ন* – *আন্তঃক্ষেত্র মূল্যায়ন:* বিভিন্ন সূচক, যেমন ছাত্রের ফলাফল, শিক্ষার মান, এবং ছাত্র-শিক্ষক মিথস্ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষার গুণমান মূল্যায়ন। *ব্যক্তিগত উন্নয়ন পরিকল্পনা:* শিক্ষকদের জন্য শিক্ষার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রদান।
৪. *মেন্টরিং প্রোগ্রাম* – *পিয়ার মেন্টরিং:* শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক মেন্টরিং চালু করা, যেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা নতুন শিক্ষকদের সাহায্য করেন। – *মেন্টর অ্যাসাইনমেন্ট:* শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিগত মেন্টর নিয়োগ, যারা শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক, এবং একাডেমিক সমর্থন প্রদান করবে।
৫. *ক্লাসরুম অবজারভেশন* – *রেগুলার ক্লাসরুম ভিজিট:* শ্রেণিকক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার কার্যকারিতা মূল্যায়ন। – *শিক্ষক-পর্যালোচনা:* শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎকার এবং আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার মান পর্যালোচনা করা।
৬. *ফিডব্যাক এবং প্রতিবেদন* – *প্রতি মাসের ফিডব্যাক:* নিয়মিত ফিডব্যাক সেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি এবং শিক্ষকের কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা। – *প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়া:* অগ্রগতি এবং সমস্যার উপর ভিত্তি করে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি এবং তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে শেয়ার করা।
৭. *অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা* – *অভিভাবক-শিক্ষক সভা:* নিয়মিত অভিভাবক-শিক্ষক সভার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের ব্যাপারে মতামত সংগ্রহ। – *ডিজিটাল যোগাযোগ:* শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের তথ্য দ্রুত এবং সহজে অভিভাবকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার।
৮. *শিক্ষাগত গবেষণা এবং উদ্ভাবন* – *পাইলট প্রকল্প:* নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির জন্য পাইলট প্রকল্প চালু এবং ফলাফল মূল্যায়ন। – *গবেষণা সহযোগিতা:* শিক্ষামূলক গবেষণা এবং উদ্ভাবনের জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে সহযোগিতা।
৯. *শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত উন্নয়ন* – *নিয়মিত প্রশিক্ষণ:* নতুন শিক্ষণ কৌশল, ICT ব্যবহারের দক্ষতা, এবং শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সমর্থনের উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালা।
১০. *পেশাগত উন্নয়ন:* শিক্ষকদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সমর্থন। এই কৌশলগুলি Vision 2041, নির্বাচনী ইশতেহার, এবং নতুন পাঠ্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং এগুলো প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।কোয়ালিটি অ্যান্ শিওর করতে হলে শিক্ষার্থীর কাছে ফিরতে হবে শিক্ষার্থীর উন্নয়নের ভূমিকা রাখতে হবে পরীক্ষা পদ্ধতির না থাকলেও তাদের মূল্যায়ন থাকতে হবে কারণ শিশু কাজটি সঠিক করছে নাকি ভুল করছে।সেটি যাচাই প্রয়োজন। ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধানতম উপায় হলেও দেশে শিক্ষায় অর্থায়ন এখনও হতাশাব্যঞ্জক। ইউনেসকো গঠিত ‘একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন’ তথা ইউনেসকো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে (১৯৯৭) এ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মানব সম্পদের সার্বিক উন্নয়ন। জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করতে হলে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রধান উপাদান। বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়াতে ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার। গুণগত শিক্ষা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অর্জনের আশা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন অনেক উপাদানের সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকা-। গুণগত শিক্ষার জন্য যেসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয় সেগুলো হচ্ছে-আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানসামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার সব স্তরে গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলোর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে অভিভাবক, বিদ্যালয় বা শিক্ষকদের ইচ্ছা এবং পছন্দ মোতাবেক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কী হতে চায়, কিংবা কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীর পছন্দ বা মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। এতে তার পঠিতব্য বিষয় সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবে; ফলে সে পাঠে মনোযোগী হবে, শিক্ষাগ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হবে এবং আশানুরূপ ফলাফল করবে। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার নতুন ভবন নির্মাণ করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতে সক্ষম হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ আয়োজন করে শিক্ষার সঙ্গে সমাজকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার মনোন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে। বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক শিশু জরিপপূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা। নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট কার্যক্রম, এসএসসি ও পিটিএ সভা বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ, উপবৃত্তি প্রদানসহ মাসিক কার্যক্রমে মাঠ প্রশাসন আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীল আচরণের ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধিত হবে। টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে রূপকল্প ২০২১, ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার আধুনিকায়ন অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত উৎপাদনমুখী অভিযোজনে সক্ষম, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের শিক্ষা পরিবারের সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখকঃ মনিকা পারভীন
উপজেলা শিক্ষা অফিসার,ময়মনসিংহ সদর।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাভাবনা’

আপডেট সময় : ১০:১৪:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জুলাই ২০২৪

শিক্ষা- মনের বন্ধ দরোজাগুলো উন্মোচন করে, আচরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে সত্যিকার মানুষ তৈরি করে। আধুনিক ,স্মার্ট ও সভ্য জাতির এগিয়ে যাওয়ার মূল নির্দেশিকা হলো গুনগত শিক্ষা। জীবন আলোকিত করার পাশাপাশি অভিষ্ঠ উন্নয়ন লক্ষ্য ( SDG) পূরণে শিক্ষা অন্যতম অবলম্বন। মেধা- মননে আধুনিক ও চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই পারে একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে সরকারের একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার প্রথম সোপান। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষার দর্শন ও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা একই সুতোয় গাঁথা। তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন, যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষাই শিক্ষার মূল ভিত্তি। তাই এই শিক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি প্রেস নোটের মাধ্যমে জানানো হয় যে, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে। বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং তারই সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। বর্তমানে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিক্ষানুরাগী। তিনি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তিমূল। বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও দর্শনকে ধারণ করে যেকোনো জাতি একটি আধুনিক কর্মমুখী এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর যে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা যাবে এবং সোনার বাংলা বিনির্মাণ সহজতর হবে। দক্ষ মানব সম্পদ বা সোনার বাংলা গড়তে আমাদের শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। আর এই শিক্ষার ভিতই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা দর্শন অনুসরণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ৩৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নং অভীষ্ট হলো মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমাজতান্ত্রিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা।) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নে দক্ষ জনসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপ-খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৪.৫ ও ৩.৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ ০.৯২ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে ২ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। : ভিশন-৪১ নির্বাচনী ইশতেহার এবং নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মনিটরিং এবং মেন্টরিংয়ের কয়েকটি আকর্ষণীয় দিক হতে পারে:
১. *ডিজিটাল মনিটরিং* – *ই-মনিটরিং সিস্টেম:* শিক্ষার অগ্রগতি ট্র্যাক করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা, যেমন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, মূল্যায়ন, এবং শিক্ষকের কর্মক্ষমতা। – *অনলাইন ড্যাশবোর্ড:* শিক্ষকদের, অভিভাবকদের, এবং প্রশাসকদের জন্য একটি ড্যাশবোর্ড, যেখানে তারা শিক্ষার বিভিন্ন সূচকের তথ্য দেখতে পারে।
২. *নিরীক্ষণ সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি* – *স্মার্ট ক্লাসরুম:* শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সিসিটিভি, ইন্টারেক্টিভ বোর্ড, এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার। – *ডেটা অ্যানালিটিক্স:* শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স এবং উপস্থিতির ডেটা বিশ্লেষণ করে সমস্যাগুলি সনাক্ত এবং সমাধান করা।
৩. *পারফরম্যান্স মূল্যায়ন* – *আন্তঃক্ষেত্র মূল্যায়ন:* বিভিন্ন সূচক, যেমন ছাত্রের ফলাফল, শিক্ষার মান, এবং ছাত্র-শিক্ষক মিথস্ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষার গুণমান মূল্যায়ন। *ব্যক্তিগত উন্নয়ন পরিকল্পনা:* শিক্ষকদের জন্য শিক্ষার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রদান।
৪. *মেন্টরিং প্রোগ্রাম* – *পিয়ার মেন্টরিং:* শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক মেন্টরিং চালু করা, যেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা নতুন শিক্ষকদের সাহায্য করেন। – *মেন্টর অ্যাসাইনমেন্ট:* শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিগত মেন্টর নিয়োগ, যারা শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক, এবং একাডেমিক সমর্থন প্রদান করবে।
৫. *ক্লাসরুম অবজারভেশন* – *রেগুলার ক্লাসরুম ভিজিট:* শ্রেণিকক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার কার্যকারিতা মূল্যায়ন। – *শিক্ষক-পর্যালোচনা:* শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎকার এবং আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার মান পর্যালোচনা করা।
৬. *ফিডব্যাক এবং প্রতিবেদন* – *প্রতি মাসের ফিডব্যাক:* নিয়মিত ফিডব্যাক সেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি এবং শিক্ষকের কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা। – *প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়া:* অগ্রগতি এবং সমস্যার উপর ভিত্তি করে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি এবং তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে শেয়ার করা।
৭. *অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা* – *অভিভাবক-শিক্ষক সভা:* নিয়মিত অভিভাবক-শিক্ষক সভার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের ব্যাপারে মতামত সংগ্রহ। – *ডিজিটাল যোগাযোগ:* শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের তথ্য দ্রুত এবং সহজে অভিভাবকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার।
৮. *শিক্ষাগত গবেষণা এবং উদ্ভাবন* – *পাইলট প্রকল্প:* নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির জন্য পাইলট প্রকল্প চালু এবং ফলাফল মূল্যায়ন। – *গবেষণা সহযোগিতা:* শিক্ষামূলক গবেষণা এবং উদ্ভাবনের জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে সহযোগিতা।
৯. *শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত উন্নয়ন* – *নিয়মিত প্রশিক্ষণ:* নতুন শিক্ষণ কৌশল, ICT ব্যবহারের দক্ষতা, এবং শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সমর্থনের উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালা।
১০. *পেশাগত উন্নয়ন:* শিক্ষকদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সমর্থন। এই কৌশলগুলি Vision 2041, নির্বাচনী ইশতেহার, এবং নতুন পাঠ্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং এগুলো প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।কোয়ালিটি অ্যান্ শিওর করতে হলে শিক্ষার্থীর কাছে ফিরতে হবে শিক্ষার্থীর উন্নয়নের ভূমিকা রাখতে হবে পরীক্ষা পদ্ধতির না থাকলেও তাদের মূল্যায়ন থাকতে হবে কারণ শিশু কাজটি সঠিক করছে নাকি ভুল করছে।সেটি যাচাই প্রয়োজন। ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধানতম উপায় হলেও দেশে শিক্ষায় অর্থায়ন এখনও হতাশাব্যঞ্জক। ইউনেসকো গঠিত ‘একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন’ তথা ইউনেসকো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে (১৯৯৭) এ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মানব সম্পদের সার্বিক উন্নয়ন। জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করতে হলে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রধান উপাদান। বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়াতে ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার। গুণগত শিক্ষা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অর্জনের আশা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন অনেক উপাদানের সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকা-। গুণগত শিক্ষার জন্য যেসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয় সেগুলো হচ্ছে-আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানসামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার সব স্তরে গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলোর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে অভিভাবক, বিদ্যালয় বা শিক্ষকদের ইচ্ছা এবং পছন্দ মোতাবেক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কী হতে চায়, কিংবা কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীর পছন্দ বা মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। এতে তার পঠিতব্য বিষয় সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবে; ফলে সে পাঠে মনোযোগী হবে, শিক্ষাগ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হবে এবং আশানুরূপ ফলাফল করবে। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার নতুন ভবন নির্মাণ করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতে সক্ষম হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ আয়োজন করে শিক্ষার সঙ্গে সমাজকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার মনোন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে। বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক শিশু জরিপপূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা। নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট কার্যক্রম, এসএসসি ও পিটিএ সভা বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ, উপবৃত্তি প্রদানসহ মাসিক কার্যক্রমে মাঠ প্রশাসন আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীল আচরণের ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধিত হবে। টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে রূপকল্প ২০২১, ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার আধুনিকায়ন অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত উৎপাদনমুখী অভিযোজনে সক্ষম, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের শিক্ষা পরিবারের সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখকঃ মনিকা পারভীন
উপজেলা শিক্ষা অফিসার,ময়মনসিংহ সদর।