ঢাকা ০৮:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক কত, অবৈধ কারা?

দেশের আওয়াজ ডেস্কঃ
  • আপডেট সময় : ০৩:২০:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৪ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশে কোনো বিদেশিকে অবৈধভাবে থাকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমরা অবৈধ বিদেশিদের বিষয়ে সতর্ক করেছি।

বড় দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক শেষে তিনি কথা জানান। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, অবৈধভাবে কোনো বিদেশি নাগরিকদের সরকার বাংলাদেশে থাকতে দেবে না।

কোন দেশের কত নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, কতজন আছে, সেই পরিসংখ্যানটা এখন আমাদের কাছে নেই। অনেক দেশেরই আছে, আমি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। তবে কোনো দেশেরই অবৈধ নাগরিকদের আমরা বাংলাদেশে থাকতে দেব না।

এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, এটা হঠাৎ করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে এটা জড়িত নয়। এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণও নেই।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অনেক ভিনদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশ অবস্থান করছেন বা কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক কত?

বাংলাদেশে বৈধভাবে বিদেশি নাগরিক কতজন অবস্থান করছেন ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার একটি হিসাব দিয়েছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ। তাদের রিপোর্ট অনুসারে ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা ছিল এক লাখ সাত হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত ভিসায় এসেছেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন, চাকরি ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, স্টাডি ভিসায় ছয় হাজার ৮২৭ এবং ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে চীনের নাগরিক ১১ হাজার ৪০৪ জন। এছাড়া বাংলাদেশে ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকও আছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে তাদের এক জরিপে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিটেন্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়।

তারা গবেষণায় দেখেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশের বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশসমূহ হচ্ছে- ভারত, চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। এদের মধ্যে ভারতের নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি কর্মী কাজ করছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল সংশ্লিষ্ট খাতে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসা সেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি কাজ করছেন।

13

গত ২৪ জুন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে জানান, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বছরে আয়ের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। তবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশিরা তাদের আয় থেকে ১৩০.৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। তার মধ্যে শীর্ষ তিন দেশ- ভারত ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার, চীন ১৪.৫৬ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ১২.৭১ মিলিয়ন ডলার নিয়েছে।

‘অবৈধ বিদেশি খেদাও আন্দোলনের’ সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ বিদেশি অবৈধভাবে আছেন। যাদের ৮০ ভাগ ভারতীয়। তবে আমাদের এই তথ্য কোনো গবেষণার ফল নয়। আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য, উইকিপিডিয়া ও গবেষণার তথ্য থেকে এটা অনুমান করছি। তাই প্রকৃত অবৈধ বিদেশির সংখ্যা জানতে গত এপ্রিলে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট অবৈধ বিদেশির সংখ্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে রুল দিয়েছেন। জানুয়ারি মাসে শুনানি হতে পারে।

অবৈধ কারা, কেন অবৈধ?

পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, আসলে পাসপোর্ট নেই বা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে এরকম অবৈধ বিদেশি বাংলাদেশে থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। যাদের অবৈধ বলা হচ্ছে তারা মূলত ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আর তারা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে বছরের পর বছর এখানে চাকরি ব্যবসা করছেন। আফ্রিকার কিছু দেশের নাগরিক আছেন যারা এখানে অবস্থান করে প্রতারক চক্র গড়ে তুলেছেন। তারা বার বার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন।

তার কথা, আয়কর ফাঁকি দিয়ে কাজ করে নিজ দেশে অর্থপাচারের জন্যই ওইসব বিদেশিরা টুরিস্ট ভিসায় এসে কাজ করছেন। বিষয়টি সবাই জানলেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বিদেশি নাগরিকদের একটি অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। কারণ, ধরা পড়লে জরিমানার অঙ্ক খুবই কম, মাত্র ৩০ হাজার টাকা। আবার অনেকে ভিসার শ্রেণি পরিবর্তন করেও বেশি দিন অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছেন।

একটি পোশাক কারখানার মালিক জানান, আসলে দক্ষ লোকের দরকার আছে আমাদের শিল্পে। আমাদের এখানে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নাই। কিন্তু সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের এখানে চাকরি দিতে অনেক সমস্যা এবং সময় সাপেক্ষ। তাই টুরিস্ট ভিসায় এনে তাদের কাজ দেয়া হয়। তবে এটা সত্য যে এর ফলে তারা আয়কর দেন না এবং হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশে অর্থ পাঠান।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা ওয়েবসাইট বিডিজবসডটকম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, বাংলাদেশে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা আছে যেখানে বিদেশিরা কাজ করেন। তাদের আসলে আন্তর্জাতিকভাবে হায়ার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে পরামর্শক আছেন। তারা আসলে অধিকাংশই বৈধভাবে কাজ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক কারখানা, বায়িং হাউজ, সেবা খাত, হেটেল, হাসপাতাল এইস প্রতিষ্ঠানে অনেক ভারতীয় কাজ করেন। তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বছরের পর বছর এখানে কাজ করেন।

তার কথা, ওইসব খাতে আসলে আমাদের দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে সত্য, কিন্তু তাদের বাইরে থেকে আনার আইনি কাঠামো আছে। সেটা মানা হচ্ছে না। এটা ক্ষতিকর। এর কারণ হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আনে তারাও যেমন কর ফাঁকি দেয়। তেমনি যারা আসেন তারাও ট্যাক্স দেন না। আসলে আমাদের সক্ষমতা গড়ে তোলা উচিত। আমরা সেদিকে নজর না দিয়ে দক্ষ জনশক্তির জন্য এখানো বিদেশনির্ভর।’

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, আমাদের বিভিন্ন শিল্প খাতে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি হয়নি। তৈরি পোশাক, চামড়া শিল্প, আইটির বিশেষ খাতের জন্য টেকনিক্যাল দক্ষতার জনশক্তি পর্যাপ্ত নাই। তাই বিদেশি জনশক্তি আনতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশে যারা দক্ষ আছেন তাদের বেতন দিতে হয় অনেক বেশি। একই দক্ষতার জনশক্তি ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে একই বেতনে বা কখনো কম বেতনে পাওয়া যায়। আর ভারত থেকে আনা সহজ। ফলে সেখান থেকে আনা হয়। যদি থাইল্যান্ডে একই বেতনে পাওয়া যেত তাহলে ওখান থেকে আনা হতো।

তিনি বলেন, তবে সমস্যাটা হচ্ছে এই বিদেশিরা ওয়ার্ক পারমিট বা চাকরির ভিসা না নিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় আসে এবং বছরের পর বছর থাকে। ট্যাক্স দেয় না, অর্থপাচার করে। এরজন্য শিল্প মালিক এবং বিদেশি উভয়ই দায়ী। শিল্প মালিকও কর ফাঁকি দেয়।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে এটা ভালো। এইদেশে কাজ করতে হলে বৈধভাবে কাজ করতে হবে। কেনো দেশেই তো অবৈধভাবে কাজ করার সুযোগ নাই। সূত্র: ডয়চে ভেলে

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক কত, অবৈধ কারা?

আপডেট সময় : ০৩:২০:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে কোনো বিদেশিকে অবৈধভাবে থাকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমরা অবৈধ বিদেশিদের বিষয়ে সতর্ক করেছি।

বড় দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক শেষে তিনি কথা জানান। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, অবৈধভাবে কোনো বিদেশি নাগরিকদের সরকার বাংলাদেশে থাকতে দেবে না।

কোন দেশের কত নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, কতজন আছে, সেই পরিসংখ্যানটা এখন আমাদের কাছে নেই। অনেক দেশেরই আছে, আমি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। তবে কোনো দেশেরই অবৈধ নাগরিকদের আমরা বাংলাদেশে থাকতে দেব না।

এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, এটা হঠাৎ করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে এটা জড়িত নয়। এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণও নেই।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অনেক ভিনদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশ অবস্থান করছেন বা কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক কত?

বাংলাদেশে বৈধভাবে বিদেশি নাগরিক কতজন অবস্থান করছেন ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার একটি হিসাব দিয়েছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ। তাদের রিপোর্ট অনুসারে ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা ছিল এক লাখ সাত হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত ভিসায় এসেছেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন, চাকরি ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, স্টাডি ভিসায় ছয় হাজার ৮২৭ এবং ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে চীনের নাগরিক ১১ হাজার ৪০৪ জন। এছাড়া বাংলাদেশে ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকও আছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে তাদের এক জরিপে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিটেন্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়।

তারা গবেষণায় দেখেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশের বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশসমূহ হচ্ছে- ভারত, চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। এদের মধ্যে ভারতের নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি কর্মী কাজ করছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল সংশ্লিষ্ট খাতে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসা সেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি কাজ করছেন।

13

গত ২৪ জুন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে জানান, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বছরে আয়ের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। তবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশিরা তাদের আয় থেকে ১৩০.৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। তার মধ্যে শীর্ষ তিন দেশ- ভারত ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার, চীন ১৪.৫৬ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ১২.৭১ মিলিয়ন ডলার নিয়েছে।

‘অবৈধ বিদেশি খেদাও আন্দোলনের’ সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ বিদেশি অবৈধভাবে আছেন। যাদের ৮০ ভাগ ভারতীয়। তবে আমাদের এই তথ্য কোনো গবেষণার ফল নয়। আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য, উইকিপিডিয়া ও গবেষণার তথ্য থেকে এটা অনুমান করছি। তাই প্রকৃত অবৈধ বিদেশির সংখ্যা জানতে গত এপ্রিলে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট অবৈধ বিদেশির সংখ্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে রুল দিয়েছেন। জানুয়ারি মাসে শুনানি হতে পারে।

অবৈধ কারা, কেন অবৈধ?

পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, আসলে পাসপোর্ট নেই বা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে এরকম অবৈধ বিদেশি বাংলাদেশে থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। যাদের অবৈধ বলা হচ্ছে তারা মূলত ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আর তারা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে বছরের পর বছর এখানে চাকরি ব্যবসা করছেন। আফ্রিকার কিছু দেশের নাগরিক আছেন যারা এখানে অবস্থান করে প্রতারক চক্র গড়ে তুলেছেন। তারা বার বার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন।

তার কথা, আয়কর ফাঁকি দিয়ে কাজ করে নিজ দেশে অর্থপাচারের জন্যই ওইসব বিদেশিরা টুরিস্ট ভিসায় এসে কাজ করছেন। বিষয়টি সবাই জানলেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বিদেশি নাগরিকদের একটি অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। কারণ, ধরা পড়লে জরিমানার অঙ্ক খুবই কম, মাত্র ৩০ হাজার টাকা। আবার অনেকে ভিসার শ্রেণি পরিবর্তন করেও বেশি দিন অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছেন।

একটি পোশাক কারখানার মালিক জানান, আসলে দক্ষ লোকের দরকার আছে আমাদের শিল্পে। আমাদের এখানে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নাই। কিন্তু সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের এখানে চাকরি দিতে অনেক সমস্যা এবং সময় সাপেক্ষ। তাই টুরিস্ট ভিসায় এনে তাদের কাজ দেয়া হয়। তবে এটা সত্য যে এর ফলে তারা আয়কর দেন না এবং হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশে অর্থ পাঠান।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা ওয়েবসাইট বিডিজবসডটকম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, বাংলাদেশে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা আছে যেখানে বিদেশিরা কাজ করেন। তাদের আসলে আন্তর্জাতিকভাবে হায়ার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে পরামর্শক আছেন। তারা আসলে অধিকাংশই বৈধভাবে কাজ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক কারখানা, বায়িং হাউজ, সেবা খাত, হেটেল, হাসপাতাল এইস প্রতিষ্ঠানে অনেক ভারতীয় কাজ করেন। তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বছরের পর বছর এখানে কাজ করেন।

তার কথা, ওইসব খাতে আসলে আমাদের দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে সত্য, কিন্তু তাদের বাইরে থেকে আনার আইনি কাঠামো আছে। সেটা মানা হচ্ছে না। এটা ক্ষতিকর। এর কারণ হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আনে তারাও যেমন কর ফাঁকি দেয়। তেমনি যারা আসেন তারাও ট্যাক্স দেন না। আসলে আমাদের সক্ষমতা গড়ে তোলা উচিত। আমরা সেদিকে নজর না দিয়ে দক্ষ জনশক্তির জন্য এখানো বিদেশনির্ভর।’

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, আমাদের বিভিন্ন শিল্প খাতে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি হয়নি। তৈরি পোশাক, চামড়া শিল্প, আইটির বিশেষ খাতের জন্য টেকনিক্যাল দক্ষতার জনশক্তি পর্যাপ্ত নাই। তাই বিদেশি জনশক্তি আনতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশে যারা দক্ষ আছেন তাদের বেতন দিতে হয় অনেক বেশি। একই দক্ষতার জনশক্তি ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে একই বেতনে বা কখনো কম বেতনে পাওয়া যায়। আর ভারত থেকে আনা সহজ। ফলে সেখান থেকে আনা হয়। যদি থাইল্যান্ডে একই বেতনে পাওয়া যেত তাহলে ওখান থেকে আনা হতো।

তিনি বলেন, তবে সমস্যাটা হচ্ছে এই বিদেশিরা ওয়ার্ক পারমিট বা চাকরির ভিসা না নিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় আসে এবং বছরের পর বছর থাকে। ট্যাক্স দেয় না, অর্থপাচার করে। এরজন্য শিল্প মালিক এবং বিদেশি উভয়ই দায়ী। শিল্প মালিকও কর ফাঁকি দেয়।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে এটা ভালো। এইদেশে কাজ করতে হলে বৈধভাবে কাজ করতে হবে। কেনো দেশেই তো অবৈধভাবে কাজ করার সুযোগ নাই। সূত্র: ডয়চে ভেলে