প্রি-পেইড মিটারের বাড়তি বিদ্যুৎ বিলে নাভিশ্বাস গ্রাহকের
- আপডেট সময় : ১১:৩৪:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৬ বার পড়া হয়েছে
রাজশাহীসহ সারা দেশে বিদ্যুৎ বিতরণে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বসছে প্রি-পেইড মিটার। কিন্তু ভোগান্তি কমানোর কথা বলে চালু করা এসব প্রি-পেইড মিটার বর্তমানে অনেক সাধারণ গ্রাহকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, কয়েক মাস ধরে বিতরণ কম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের চেয়ে টাকা (বিল) বেশি কেটে নিচ্ছে। জরুরি ব্যালান্স নিতে গুনতে হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত সুদ।
বাড়তি বিদ্যুৎ বিলে নাভিশ্বাস গ্রাহকেরআবার গত মে-জুন মাসের পর থেকে বেশির ভাগ গ্রাহকের বিল আসছে দ্বিগুণের বেশি। চলতি সেপ্টেম্বরে বিলের এই উত্তাপ আরো বেড়েছে। আগে যাঁদের গড়ে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা বিল দিতে হতো, এখন তাঁদের দিতে হচ্ছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিদ্যুৎ বিলের পেছনে বাড়তি টাকা খরচ করতে গিয়ে নাভিশ্বাস সাধারণ গ্রাহকের। বিষয়টি রাজপথের আন্দোলন পর্যন্ত গড়িয়েছে। রাজশাহীতে প্রি-পেইড মিটার বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশও করা হয়েছে। কদিন আগে নেসকোর কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুমকিও দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এখনো বন্ধ হয়নি প্রি-পেইড মিটারের হয়রানি ও বাণিজ্য।
বিতরণ কম্পানিগুলো বলছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে না, যতটুকু গ্রাহক ব্যবহার করছে, তার বেশি টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে। দেশে ছয়টি কম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কম্পানি (নেসকো)। এসব বিতরণ কম্পানির মোট গ্রাহক প্রায় চার কোটি ৭১ লাখ। এর মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় ৫২ লাখ গ্রাহক প্রি-পেইড মিটারের আওতায় রয়েছে। বাকিদের ক্রমান্বয়ে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনার কাজ চলছে।
রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা অভিযোগ করে বলেন, ‘গত এপ্রিল মাস থেকে প্রতি মাসে আমাকে বিদ্যুতে দ্বিগুণের বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। গত মার্চ মাসে আমার প্রি-পেইড মিটারে খরচ হয় দুই হাজার টাকার মতো। কিন্তু তার পরবর্তী মাস থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসে আমার গড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অথচ আগের মতো এখনো একই রকম বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি।’
ডিপিডিসির গ্রাহক রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. খালেদ বলেন, ‘প্রি-পেইড মিটারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক বাড়তি টাকা কেটে নেওয়ার বিষয়টি মানা যাচ্ছে না। যত বারই রিচার্জ করা হয়, ততবারই চার্জ হিসেবে বাড়তি টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। প্রি-পেইড মিটার এখন আমাদের জন্য বাড়তি ব্যয়ের মেশিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিপিডিসিতে অভিযোগ জানালে তারা বলে দিচ্ছে, আপনি বেশি ইউনিট ব্যবহার করায় বেশি টাকা কাটা যাচ্ছে।’
ময়মনসিংহের কালিবাড়ী বাইলেন এলাকার বাসিন্দা আফসার উদ্দিন জানান, প্রি-পেইড মিটারে ভোগান্তি বেড়েছে। সেই সঙ্গে আগের তুলনায় বিল বেশি দিতে হচ্ছে। আগে গরম মৌসুমে মাসিক সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা বিল আসত, প্রি-পেইড মিটারে বর্তমানে বিল তিন হাজার টাকার বেশি আসছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, বিতরণ পর্যায়ে গ্রাহককে ডিমান্ড চার্জ, মোট বিলের ৫ শতাংশ বিলম্ব মাসুল (বিলম্বে বিল পরিশোধ) এবং ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হয়। বিইআরসির অনুমোদন ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর কোনো ধরনের চার্জ বা অর্থ আরোপ করার ক্ষমতা নেই বিতরণ কম্পানির। অথচ দেশের ছয় বিতরণ কম্পানি এমন সব খাতে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ কেটে নিচ্ছে, যাতে বিইআরসির অনুমোদন নেই।
বিতরণ কম্পানিগুলো যা বলছে : জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল্লাহ নোমান বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়িয়েছেন। বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে উঁচু স্ল্যাবে চলে যায়। এতে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের হারও বেড়ে যায়। তখন গ্রাহকের কাছে মনে হয় বাড়তি টাকা কাটা হচ্ছে। আসলে উঁচু স্ল্যাবে চলে যাওয়ার কারণেই বাড়তি খরচ হচ্ছে। তবে দু-একটি মিটার কারিগরি ত্রুটির কারণেও বাড়তি টাকা কাটা হতে পারে। সেটি খুবই কম। এগুলো আমাদের নজরে আসা মাত্র মিটার পরিবর্তন বা ঠিক করে দেওয়া হয়।’
জানতে চাইলে ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুতে অনেকগুলো স্ল্যাব রয়েছে। আবাসিক গ্রাহকদের সর্বনিম্ন স্ল্যাবে (৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী) ইউনিট প্রতি পাঁচ টাকা ২৬ পয়সা হারে বিল দেয়। আর সর্বোচ্চ স্ল্যাবে (৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারকারী) ইউনিট প্রতি ১৪ টাকা ৬১ পয়সা হারে বিল দিতে হয়। মাসের প্রথমদিকে গ্রাহকরা যখন বিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু করেন তখন ৫০০ টাকায় ১০০ ইউনিট পাবেন। আর সর্বোচ্চ স্ল্যাবে গিয়ে ১০০ ইউনিট কিনতে খরচ করতে হবে এক হাজার ৫০০ টাকা। মূলত এসব কারণে গ্রাহকের বেশি টাকা কাটে।’
ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেয়েও বাড়তি বিল : তীব্র গরমের মধ্যেও গত কয়েক মাস আগে ঢাকার বাইরের উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায়নি। দিনে-রাতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। তার পরও বাড়তি বিদ্যুৎ বিল করার অভিযোগ রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পোস্ট-পেইড গ্রাহক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক মাস আমরা দিনে-রাতে ১০ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাইনি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ না পেয়ে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলেও বাড়তি বিদ্যুৎ বিল ঠিকই এসেছে। গত তিন-চার মাস আগে যখন ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকত তখন ২০০-২৫০ টাকা বিল আসত। এখন বিদ্যুৎ না থাকলেও বিল আসছে প্রায় ৪৫০ টাকা।’
প্রি-পেইড মিটার বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ : বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন গ্রাহকরা। গত বুধবার রাজধানীর ডেমরায় ডিপিডিসির অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন গ্রাহকরা।
সূত্র: কালের কণ্ঠ