ঢাকা ০১:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পদ্মা সেতু প্রকল্প: ২০ দালালের তালিকা দুদকে

দেশের আওয়াজ ডেস্কঃ
  • আপডেট সময় : ১০:১১:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৩ ১৩২ বার পড়া হয়েছে

মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অভিযুক্ত দালালদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। দালালদের অনুসন্ধানের জন্য তালিকা ইতোমধ্যেই দুদকে প্রেরণ করেছে প্রশাসন।

তালিকার শীর্ষ দালাল নাসির কাজীর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, সে প্রায় ২০১৯ সাল থেকেই শিবচর এলাকা থেকে পলাতক রয়েছে। এক সময়ের গ্রাম্য পশু চিকিৎসক নাসিরের বিরুদ্ধে ঢাকা, কক্সবাজার ও দেশের বাইরে শত কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে বলে তার সহযোগীরা দাবী করেন। যে সকল সহযোগীর দিয়ে দালালরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের কেউ কেউ জেলও খেটেছে।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শিবচরের ডাইয়ারচর মৌজায় পদ্মা সেতুর রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হারুণ বেপারী, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেনসহ পাশ্ববর্তীরা দোকানঘর ও জমির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ ধারা, ৭ ধারা ও ৮ ধারা নোটিশ পান। তবে নোটিশ পেয়ে ডিসি অফিসে বারবার ঘুরেও বিল পাচ্ছিল না তারা। দীর্ঘ চেষ্টার পর ক্ষতিগ্রস্থরা জানতে পারেন ওই দাগগুলো থেকে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গেছে দালাল চক্রের সদস্যরা। ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় এই ভুয়া বিল উঠানোর অভিযোগে শাহীন বেপারী নামের এক দালালকে আটক করে পুলিশ। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি মামলায় আসামী হয় জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত শীর্ষ দালাল নাসির কাজী, তার ২ মামা ও এক নিকটাত্মীয়। আসামীদের কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্তে¡ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলও শাখার জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরীর কয়েকজন দক্ষ সার্ভেয়ার ও কানুনগোর সহায়তায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে দালালদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট হয়। গ্রেফতারকৃত শাহীনের পরিবার (দালাল নাসিরের সহযোগী) আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। শাহীনের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার বিল ছাড় হলেও লোপাটকৃত টাকার মাত্র ২০ লাখ টাকা ভাগ পায় তারা। বাকি টাকা নেয় নাসিরসহ অফিসের লোকজন। বিল তোলার আগে সব দায়ভার দালাল চক্র নিতে চাইলেও এখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু শাহীন বেপারীই নয়, চক্রটির লোভে পা দিয়ে ২ লাখ টাকা ভাগ পেয়ে জেল খাটেন ইউপি সদস্য শুধাংশু মন্ডল। ২ লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও ৪৫ হাজার টাকা ভাগ পেয়ে তদন্তের মুখে পড়েছেন আলো পত্তনদারসহ আরো অনেকে। এছাড়াও চক্রটি ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এলও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সুচতুর সার্ভেয়ার ও কানুনগোর সাথে মিলেমিশে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ভিপি ও খাস সম্পত্তি থেকে দাবী এক সময়ের সহযোগীদের। এদের মধ্যে ডিসি অফিসের এলএ শাখার বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে থাকা সাবেক সার্ভেয়ার রাসেল ও মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে চাকুরীচ্যুত), মাইনুল, তাহের, সোহেল মিয়াজী কারসাজি করে অসংখ্য ব্যক্তির নামে সরকারি খাস জমির ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দিয়ে জমির ক্ষতিপূরনের টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে।

ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্থ হারুণ বেপারী বলেন, ‘আমাদের জমির সকল কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও অন্য এলাকার বাসিন্দা দালাল নাসির, শাহীনসহ দালাল চক্রটি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ডিসি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিলের প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। এই অঞ্চলে এদের কোন জমিও নেই। যার কারণে আমরা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো পাইনি। দালাল নাসির এবং তার দুই মামাকে আটক করতে পারলে অনেক টাকা উদ্ধার করা যাবে। চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।’

আরেক ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্থ খোকন সিকদার বলেন, ‘আমাদের ৬ জনের মালিকানাধীন ৬৪২ নং দাগের জমি দেখিয়ে প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্রটি। এছাড়াও ডিসি অফিসের কর্মচারীদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে চক্রটি ভিপি ও খাস খতিয়ানের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শুধু ভূয়া কাগজ দিয়ে।’

গ্রেপ্তারকৃত শাহীন বেপারির ছেলে জালাল বেপারী বলেন, ‘দালাল নাসির, আলিউজ্জমান, আক্তারজামানসহ ওরা কয়েকজন মিলে আমার বাবাকে দিয়ে টাকা উত্তোলনের এই কাজটি করিয়েছে। জাল কাগজপত্র তৈরি করেছে নাসিরের মামা আক্তারুজ্জামান। আমার বাবার ব্যাংক একাউন্টে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা আসলে নাসির, আক্তারুজ্জামানরা তাকে ভয় দেখিয়ে দুই চেকের মাধ্যমে সকল টাকা ওদের একটি এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নেয়। এর থেকে বাবাকে ২০ লাখ টাকা দেয়। এত বড় ঘটনা আবার বাবা আমাদের পরিবারের কাউকেই বলেনি। পরে যখন সরকারী কর্মকর্তারা তদন্তে আমাদের বাড়ি আসে তখন আমার বাবা তাদের কাছে সকল ঘটনা খুলে বললে আমার বাবাকে তারা ডিসি অফিসে যেতে বলেন। আমার বাবা ডিসি অফিসে গেলে ডিসি সাহেব সকল কথা শোনার পর আমার বাবাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এত বড় ঘটনার যারা মূলহোতা তাদেরকে এখনো পুলিশ ধরতে পারেনি। তার মধ্যে আক্তারুজ্জামান আর আরেকজন জামিনও পেয়ে গেছে। এত বড় দালালরা কিভাবে জামিন পায়? দালাল নাসির কোথায় আছে কেউ জানে না। আর নজরুল সম্ভবত ঢাকায় আছে। কিন্তু ওদের বাড়ির লোকজন ঠিকানা বলে না। আমার বাবাকে আটকের পর ওদের কাছে গিয়েছিলাম তখন ওরা কোন সহযোগিতা করেনি। বরং ওরা বলেছে আমাদের না জানিয়ে তোমার বাবা পুলিশের কাছে ধরা দিলো কেন? এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।’

গ্রেপ্তারকৃত ইউপি সদস্য সুধাংশ মন্ডল (নাসিরের সহযোগী) বলেন, ‘কোন জমির মালিক আছে আর কোন জমির মালিক নেই এ সকল ফাঁক ফোকরতো কানুনগো ছাড়া আর কেউ জানে না। ডিসি অফিসের এসকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা দালাল নাসিরের সাথে যোগাযোগ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি হলে হিন্দু ধর্মের লোক, জেলেদের জমি হলে জেলে সম্প্রদায়ের লোক সেট করে শুধুমাত্র আইডি কার্ড নিয়ে বাকি জমির সকল কাগজপত্র জাল দলিল তৈরি করে ওরা ক্ষতিপূরনের টাকা উত্তোলন করেছে। আমার ধারণা নাসির কাজী, মতিউর কাজী, নাসিরের দুই মামাসহ চক্রটি প্রায় ২‘শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমার জানামতে নাসির কাজী কক্সবাজারে দশ তলা একটি হোটেল করেছে, গুলশানে একটি ফ্লাট কিনেছে। আমি জেল থেকে আসার পরে নাসিরের সাথে দুই বার কথা হয়েছে। আমার নামের আত্মসাতকৃত টাকার ১৬ লাখ টাকা নাসির ডিসি অফিসে জমাও দিয়েছে। পরে আবার যখন তদন্ত আসে তখন নাসিরসহ ওরা আমাকে হুমকি দিয়েছে যেন নাসিরের দুই মামাসহ ওদের কারো নাম না বলি। তখন ওদের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়।’

আলো পত্তনদার নামের আরেক মহিলা বলেন, ‘আমাকে ২ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলে নাসির, নাসিরের মামাসহ ওরা আমাকে কয়েকবার মাদারীপুর ডিসি অফিসে নিয়ে যায়। বিভিন্ন কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয়। পরে ওরা কত টাকা বিল উত্তোলন করেছে সেটা আমাকে বলেনি। টাকা উত্তোলন শেষে ওরা আমাকে মাত্র ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছে।’

শীর্ষ অভিযুক্ত দালাল নাসিরের খোঁজ নিতে তার ভাই মতিউর কাজীকে ফোন দিলে সে জানায়, ‘আমার ভাই ঢাকা আছে নাকি ইন্ডিয়া আছে তা আমার জানা নেই। প্রায় দুই-আড়াই বছর ধরে বাড়িতে আসে না। আর আমি কোন মামলায় জেলে গিয়েছিলাম তা আমার জানা নেই।’

২য় শীর্ষ অভিযুক্ত দালাল ফরিদ শেখ মোবাইলে বলেন, ‘ডিসি অফিস আরো আগে আমার নামে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। পরে প্রায় ৫ মাস আগে মাদারীপুর দুদক অফিস থেকে আমাকে ডেকেছিল। আমি সেখানে গিয়ে তারা যা জানতে চেয়েছে তার জবাব দিয়েছি। আমি যদি কোন দূর্নীতি করি তবে তদন্ত করে তা প্রমান করেন। আমার চাকুরীর সুবাদে আগের অফিসারদের সাথে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল। বর্তমান স্যারেরা আগের অফিসারদের সাথে কাদের ভাল সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়েই তারা আমাকে সন্দেহ করেছে।’

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, রেলওয়ে প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প আমাদের এখানে বাস্তবায়ন হয়েছে। এসকল প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহন অন্যতম একটি কার্যক্রম। এই ভূমি অধিগ্রহনের কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি এখানে একটি দালালচক্র গড়ে উঠেছে। এই দালালচক্র পদ্মা সেতু, রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহনের সাথে জড়িত ছিল। সেটা আমরা চিহিৃত করে ২০ জন দালালের একটি তালিকা আমরা তৈরি করেছি। এই ২০ জন দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এই দালালদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে, তদন্ত করছে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

পদ্মা সেতু প্রকল্প: ২০ দালালের তালিকা দুদকে

আপডেট সময় : ১০:১১:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৩

মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অভিযুক্ত দালালদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। দালালদের অনুসন্ধানের জন্য তালিকা ইতোমধ্যেই দুদকে প্রেরণ করেছে প্রশাসন।

তালিকার শীর্ষ দালাল নাসির কাজীর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, সে প্রায় ২০১৯ সাল থেকেই শিবচর এলাকা থেকে পলাতক রয়েছে। এক সময়ের গ্রাম্য পশু চিকিৎসক নাসিরের বিরুদ্ধে ঢাকা, কক্সবাজার ও দেশের বাইরে শত কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে বলে তার সহযোগীরা দাবী করেন। যে সকল সহযোগীর দিয়ে দালালরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের কেউ কেউ জেলও খেটেছে।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শিবচরের ডাইয়ারচর মৌজায় পদ্মা সেতুর রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হারুণ বেপারী, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেনসহ পাশ্ববর্তীরা দোকানঘর ও জমির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ ধারা, ৭ ধারা ও ৮ ধারা নোটিশ পান। তবে নোটিশ পেয়ে ডিসি অফিসে বারবার ঘুরেও বিল পাচ্ছিল না তারা। দীর্ঘ চেষ্টার পর ক্ষতিগ্রস্থরা জানতে পারেন ওই দাগগুলো থেকে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গেছে দালাল চক্রের সদস্যরা। ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় এই ভুয়া বিল উঠানোর অভিযোগে শাহীন বেপারী নামের এক দালালকে আটক করে পুলিশ। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি মামলায় আসামী হয় জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত শীর্ষ দালাল নাসির কাজী, তার ২ মামা ও এক নিকটাত্মীয়। আসামীদের কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্তে¡ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলও শাখার জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরীর কয়েকজন দক্ষ সার্ভেয়ার ও কানুনগোর সহায়তায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে দালালদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট হয়। গ্রেফতারকৃত শাহীনের পরিবার (দালাল নাসিরের সহযোগী) আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। শাহীনের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার বিল ছাড় হলেও লোপাটকৃত টাকার মাত্র ২০ লাখ টাকা ভাগ পায় তারা। বাকি টাকা নেয় নাসিরসহ অফিসের লোকজন। বিল তোলার আগে সব দায়ভার দালাল চক্র নিতে চাইলেও এখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু শাহীন বেপারীই নয়, চক্রটির লোভে পা দিয়ে ২ লাখ টাকা ভাগ পেয়ে জেল খাটেন ইউপি সদস্য শুধাংশু মন্ডল। ২ লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও ৪৫ হাজার টাকা ভাগ পেয়ে তদন্তের মুখে পড়েছেন আলো পত্তনদারসহ আরো অনেকে। এছাড়াও চক্রটি ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এলও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সুচতুর সার্ভেয়ার ও কানুনগোর সাথে মিলেমিশে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ভিপি ও খাস সম্পত্তি থেকে দাবী এক সময়ের সহযোগীদের। এদের মধ্যে ডিসি অফিসের এলএ শাখার বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে থাকা সাবেক সার্ভেয়ার রাসেল ও মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে চাকুরীচ্যুত), মাইনুল, তাহের, সোহেল মিয়াজী কারসাজি করে অসংখ্য ব্যক্তির নামে সরকারি খাস জমির ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দিয়ে জমির ক্ষতিপূরনের টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে।

ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্থ হারুণ বেপারী বলেন, ‘আমাদের জমির সকল কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও অন্য এলাকার বাসিন্দা দালাল নাসির, শাহীনসহ দালাল চক্রটি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ডিসি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিলের প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। এই অঞ্চলে এদের কোন জমিও নেই। যার কারণে আমরা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো পাইনি। দালাল নাসির এবং তার দুই মামাকে আটক করতে পারলে অনেক টাকা উদ্ধার করা যাবে। চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।’

আরেক ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্থ খোকন সিকদার বলেন, ‘আমাদের ৬ জনের মালিকানাধীন ৬৪২ নং দাগের জমি দেখিয়ে প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্রটি। এছাড়াও ডিসি অফিসের কর্মচারীদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে চক্রটি ভিপি ও খাস খতিয়ানের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শুধু ভূয়া কাগজ দিয়ে।’

গ্রেপ্তারকৃত শাহীন বেপারির ছেলে জালাল বেপারী বলেন, ‘দালাল নাসির, আলিউজ্জমান, আক্তারজামানসহ ওরা কয়েকজন মিলে আমার বাবাকে দিয়ে টাকা উত্তোলনের এই কাজটি করিয়েছে। জাল কাগজপত্র তৈরি করেছে নাসিরের মামা আক্তারুজ্জামান। আমার বাবার ব্যাংক একাউন্টে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা আসলে নাসির, আক্তারুজ্জামানরা তাকে ভয় দেখিয়ে দুই চেকের মাধ্যমে সকল টাকা ওদের একটি এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নেয়। এর থেকে বাবাকে ২০ লাখ টাকা দেয়। এত বড় ঘটনা আবার বাবা আমাদের পরিবারের কাউকেই বলেনি। পরে যখন সরকারী কর্মকর্তারা তদন্তে আমাদের বাড়ি আসে তখন আমার বাবা তাদের কাছে সকল ঘটনা খুলে বললে আমার বাবাকে তারা ডিসি অফিসে যেতে বলেন। আমার বাবা ডিসি অফিসে গেলে ডিসি সাহেব সকল কথা শোনার পর আমার বাবাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এত বড় ঘটনার যারা মূলহোতা তাদেরকে এখনো পুলিশ ধরতে পারেনি। তার মধ্যে আক্তারুজ্জামান আর আরেকজন জামিনও পেয়ে গেছে। এত বড় দালালরা কিভাবে জামিন পায়? দালাল নাসির কোথায় আছে কেউ জানে না। আর নজরুল সম্ভবত ঢাকায় আছে। কিন্তু ওদের বাড়ির লোকজন ঠিকানা বলে না। আমার বাবাকে আটকের পর ওদের কাছে গিয়েছিলাম তখন ওরা কোন সহযোগিতা করেনি। বরং ওরা বলেছে আমাদের না জানিয়ে তোমার বাবা পুলিশের কাছে ধরা দিলো কেন? এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।’

গ্রেপ্তারকৃত ইউপি সদস্য সুধাংশ মন্ডল (নাসিরের সহযোগী) বলেন, ‘কোন জমির মালিক আছে আর কোন জমির মালিক নেই এ সকল ফাঁক ফোকরতো কানুনগো ছাড়া আর কেউ জানে না। ডিসি অফিসের এসকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা দালাল নাসিরের সাথে যোগাযোগ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি হলে হিন্দু ধর্মের লোক, জেলেদের জমি হলে জেলে সম্প্রদায়ের লোক সেট করে শুধুমাত্র আইডি কার্ড নিয়ে বাকি জমির সকল কাগজপত্র জাল দলিল তৈরি করে ওরা ক্ষতিপূরনের টাকা উত্তোলন করেছে। আমার ধারণা নাসির কাজী, মতিউর কাজী, নাসিরের দুই মামাসহ চক্রটি প্রায় ২‘শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমার জানামতে নাসির কাজী কক্সবাজারে দশ তলা একটি হোটেল করেছে, গুলশানে একটি ফ্লাট কিনেছে। আমি জেল থেকে আসার পরে নাসিরের সাথে দুই বার কথা হয়েছে। আমার নামের আত্মসাতকৃত টাকার ১৬ লাখ টাকা নাসির ডিসি অফিসে জমাও দিয়েছে। পরে আবার যখন তদন্ত আসে তখন নাসিরসহ ওরা আমাকে হুমকি দিয়েছে যেন নাসিরের দুই মামাসহ ওদের কারো নাম না বলি। তখন ওদের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়।’

আলো পত্তনদার নামের আরেক মহিলা বলেন, ‘আমাকে ২ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলে নাসির, নাসিরের মামাসহ ওরা আমাকে কয়েকবার মাদারীপুর ডিসি অফিসে নিয়ে যায়। বিভিন্ন কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয়। পরে ওরা কত টাকা বিল উত্তোলন করেছে সেটা আমাকে বলেনি। টাকা উত্তোলন শেষে ওরা আমাকে মাত্র ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছে।’

শীর্ষ অভিযুক্ত দালাল নাসিরের খোঁজ নিতে তার ভাই মতিউর কাজীকে ফোন দিলে সে জানায়, ‘আমার ভাই ঢাকা আছে নাকি ইন্ডিয়া আছে তা আমার জানা নেই। প্রায় দুই-আড়াই বছর ধরে বাড়িতে আসে না। আর আমি কোন মামলায় জেলে গিয়েছিলাম তা আমার জানা নেই।’

২য় শীর্ষ অভিযুক্ত দালাল ফরিদ শেখ মোবাইলে বলেন, ‘ডিসি অফিস আরো আগে আমার নামে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। পরে প্রায় ৫ মাস আগে মাদারীপুর দুদক অফিস থেকে আমাকে ডেকেছিল। আমি সেখানে গিয়ে তারা যা জানতে চেয়েছে তার জবাব দিয়েছি। আমি যদি কোন দূর্নীতি করি তবে তদন্ত করে তা প্রমান করেন। আমার চাকুরীর সুবাদে আগের অফিসারদের সাথে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল। বর্তমান স্যারেরা আগের অফিসারদের সাথে কাদের ভাল সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়েই তারা আমাকে সন্দেহ করেছে।’

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, রেলওয়ে প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প আমাদের এখানে বাস্তবায়ন হয়েছে। এসকল প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহন অন্যতম একটি কার্যক্রম। এই ভূমি অধিগ্রহনের কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি এখানে একটি দালালচক্র গড়ে উঠেছে। এই দালালচক্র পদ্মা সেতু, রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহনের সাথে জড়িত ছিল। সেটা আমরা চিহিৃত করে ২০ জন দালালের একটি তালিকা আমরা তৈরি করেছি। এই ২০ জন দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এই দালালদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে, তদন্ত করছে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।’