গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তথ্য: রাকসুর ফলাফল ঘিরে নতুন বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা
- আপডেট সময় : ১১:২৪:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫ ২৮ বার পড়া হয়েছে
আগামি ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। এই নির্বাচনের সম্ভব্য ফলাফল অনুধাবন করে ছাত্রসংগঠনগুলো নির্বাচন বয়কট, পরষ্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ ও ক্যাম্পাসে আন্দোলনের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রার্থীরা পরষ্পরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে পারে। বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাক হতে পারে। সেই সাথে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ও নাশকতাকারীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬২ সালে সৎ, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গঠনের লক্ষ্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) এখন পর্যন্ত ১৪ বার নির্বাচন আয়োজন করেছে। ১৯৮৯ সালে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রশাসনিক অবহেলা ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে সংঘর্ষের কারণে রাকসু কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। রাকসু নির্বাচনের দাবীতে এখন পর্যন্ত ১৩টি কর্মসূচী পালিত হয়েছে। এই নির্বাচনে ১৭টি হলের ৯টি ভোট কেন্দ্রে ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটার এর মধ্যে ১৭ হাজার ৫৯৬ পুরুষ এবং ১১ হাজার ৩৪০ জন নারী ভোটার ১ হাজার ৩৪০টি বুথে ভোটাধীকার প্রয়োগ করবে। ৯১টি টেবিলে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে।
প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাকসু নির্বাচনে হল ছাত্র সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৯ জন প্রতিনিধি এবং নির্বাহী পরিষদে ১৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে মোট ৪২টি পদে ইতোমধ্যেই জয়ী হয়েছে। অন্যদিকে মেয়েদের চারটি হলে একটি করে পদে কোনো প্রার্থী মনোনয়নপত্র উত্তোলন না করায় সেসব পদ শূন্য রয়েছে।
নির্বাচনে ভোটার শনাক্তকরণ ও নির্বাচনী সামগ্রীর ব্যবহার সঠিকভাবে সম্পন্ন না হলে প্রার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে পারে। অমোচনীয় কালি সহজে মুছে গেলে সুযোগ সন্ধানী ভোটাররা একাধিকবার ভোট দিতে পারে, ভোটার তালিকা সঠিকভাবে তৈরি না হলে কেন্দ্রগুলোতে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে এবং যদি অতিরিক্ত ব্যালট মুদ্রণ ও বিতরণ করা হয় তা নির্দিষ্ট কোন প্রার্থীর ভোট বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে ।
ভোট গণনায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা : ওএমআর মেশিন ব্যবহার না করে হাতে ভোট গণনার প্রক্রিয়াটি নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই পদ্ধতিতে গণনা করতে গেলে প্রথমেই দেখা দেয় সময়, শ্রম ও লোকবলের বিশাল সংকট। প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হলে বা একই সাথে একাধিক ব্যালট পেপার গণনা করতে হলে এই জটিলতা আরও বেড়ে যায়। কেন্দ্রভিত্তিক গণনা করলে কিছুটা সময় বাঁচলেও সার্বিকভাবে প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীরগতির হয়ে থাকে। এছাড়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকা, শিফটিং ব্যবস্থা না করা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে গণনাকাজ দীর্ঘসূত্রিতা ও বিশৃঙ্খলার মুখে পড়ে। এর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো গণনায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা, যা প্রাথমিক ফলাফল পরিবর্তন এবং বিজয়ী নির্ধারণে বিতর্ক তৈরি হতে পারে।
পদত্যাগ ও দায়িত্ব পালনের সংকট : নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যগণ পদত্যাগ করলে তা কেন্দ্রীয় নির্বাচনের কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। এটি শুধু প্রশাসনিক শূন্যস্থানই তৈরি করবে না, বরং গণনা প্রক্রিয়া স্থবির করে দিবে এবং নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী ও জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
প্রশাসনিক ও যোগাযোগের ব্যর্থতা : দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফলে প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং যোগাযোগের ত্রুটির কারণে কেন্দ্রীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা ক্ষুন্ন হতে পারে। সময় মতো প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ না হলে তা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে।
এছাড়াও, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব হলে এবং প্রশাসনিক পর্যায়ের অভ্যন্তরীণ জটিলতা থাকলে নির্বাচন পরিচালনার গতি ও স্বচ্ছতা ব্যাহত হবে। এসব বিষয় একত্রিত হয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট এবং ফলাফল সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কর্মীদের চাপ: নির্বাচনী কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে। পুলিশ, র্যাব, আনসার এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনী দায়িত্বে নিযুক্ত থাকলে দীর্ঘস্থায়ী ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে তাদের মধ্যে অসুস্থতা, শারীরিক ক্লান্তি এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রতিবেদনে সম্ভাব্য বিরোধ ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মত রাকসু নির্বাচনেও ফলাফল বা পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিলে একাধিক ছাত্র সংগঠন নির্বাচন বর্জন করে ক্যাম্পাসে আন্দোলনে করতে পারে। মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে ফলাফলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বা বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাও রয়েছে। এছাড়া, পরাজিত পক্ষ দলীয় শক্তি ব্যবহার করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল বা কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করতে পারে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঝুঁকি ও প্রভাব: স্বাধীন প্রার্থীদের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়লেও, সংগঠিত ছাত্র সংগঠনের চাপের কারণে তারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করতে পারে। নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তাদের উপর হামলার সম্ভাবনার রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রার্থীদের মধ্যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব: রাকসু নির্বাচনে প্যানেল ও স্বাধীন প্রার্থীর অংশগ্রহণের ফলে ভোটার আকর্ষণ, প্যানেল সমর্থন ও প্রচারণার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, মতবিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিতে পারে। এতে ভোট বিভাজন হয়ে নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি প্রচারণার সময় উত্তেজনা ও অস্থিরতা ভোটারদের মানসিক চাপ বাড়াতে এবং সামগ্রিক নির্বাচনী পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
ভোটার নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ: ভোটারদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটার তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট নিতে আগ্রহী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় যদি অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব বা বহিরাগত প্রভাব দেখা দেয়, তাহলে ভোটাররা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারবে না। এছাড়া, প্রার্থীদের নির্বিঘ্নে প্রচার প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা না থাকলে ভোটের সঠিক প্রতিফলন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ভোটারদের নিরাপত্তা ব্যাহত হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সমগ্র নির্বাচনী পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভাব: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির দুইটি প্যানেলের রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট; বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা প্যানেলে বিভাজন এবং আওয়ামী লীগপন্থী হলুদ প্যানেল নিষ্ক্রিয়। প্রশাসন ও গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে জামায়াতে ইসলামীপন্থী শিক্ষকদের প্রভাব লক্ষণীয়। আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকগণ গোপনভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে বলে জানা যায়। এতে রাকসু নির্বাচনের সময় সহিংসতা, অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি উন্মুক্ত ক্যাম্পাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর পুরো ক্যাম্পাসে সমানভাবে সুরক্ষিত নয়। কিছু অংশ উঁচু ও নিরাপদ থাকলেও দীর্ঘ অংশে প্রাচীর নেই বা নিচু, প্রবেশপথ খোলা থাকায় ক্যাম্পাসের বড় অংশ অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে বহিরাগতরা নির্বাচনকালীন সময় অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
গোয়ান্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিবেদনে ১৬টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলো হলো, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও নির্ভুলভাবে হালনাগাদ করা প্রয়োজন। ভোট গণনাকালে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গণনাকারী জনবল নিয়োজিত রাখা। নির্বাচনকালীন কেন্দ্রের জরুরি পরিস্থিতিতে দায়িত্ব ভাগাভাগি ও বিকল্প কর্মীর ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মনিটরিং ও সমন্বয় কক্ষ তৈরি করা প্রয়োজন। ভোট কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় গণনা কার্যক্রম ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
নির্বাচনী তথ্য সময়মতো প্রকাশ ও স্বচ্ছ যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন অভিযোগ ও অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ও নাশকতাকারীগণ রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ অস্থিতিশীল করতে ছাত্রদের মধ্যে প্রপাগান্ডা চালাতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। ছাত্রী হল ও ছাত্রী ভোটকেন্দ্রগুলোর সামনে পর্যাপ্ত সংখ্যক নারী পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা প্রয়োজন। নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের (সবার জন্য সমান সুযোগ) ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ছাত্র সংগঠনসমূহের কার্যক্রমের উপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে স্বার্থান্বেষী মহল আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে না পারে সেদিকে লক্ষ্যে রাখতে হবে। হল প্রভোস্ট ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একপক্ষীয় সমর্থন রোধে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। নির্বাচনকালীন বিশৃঙ্খলা রোধে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। নির্বাচনকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীর ও প্রবেশপথে পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। রাকসু নির্বাচনের দিন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠনের কোন সদস্য চিহ্নিত হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের সচেতন করা প্রয়োজন।


























