কতদিন চলবে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ?

- আপডেট সময় : ০৩:১৩:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫ ৩৪ বার পড়া হয়েছে
ইরানের ওপর গত ১৩ জুনের প্রথম প্রহর থেকে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। রাজধানী তেহরানসহ দেশটির শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে ওই রাতে হামলা চালায় ইসরায়েল।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করা এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে অপারেশন রাইজিং লায়ন বা জেগে ওঠা সিংহ। হামলার মূল কারণ ছিল- পশ্চিমাদের ভাষায় ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া।
অর্থাৎ ইরানের পরমাণু স্থাপনা পুরোপোরি ধ্বংসনিা করা পর্যন্ত হামলা চালাতে থাকবে ইসরায়েল। ইসরায়েল এখনো ইরানের দ্বিতীয় বৃহৎ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ফরদোতে হামলা চালায়নি। এটি ৮০-৯০ মিটার গভীরে এবং এটি ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টন ওজনের বাংকার ব্লাস্টার বোমা প্রয়োজন।
এ বোমা কেবল মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান থেকেই ছোঁড়া সম্ভব। নাতানজে পারমাণবিক কেন্দ্রে সফল হামলা মানেই যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। ফরদোর মতো ‘অপ্রবেশযোগ্য’ লক্ষ্য, ইরানের সম্ভাব্য পাল্টা হামলা এবং আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একটি দীর্ঘ, অনিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ইঙ্গিতই দিচ্ছে। যার কোনো তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি দেখা যাচ্ছে না।
ইসরায়েলি হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যকে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে- এমন আশঙ্কাই করেন বিশ্লেষকরা। তার মধ্যেই ইসরায়েলি হামলার জবাবে ‘ট্রু প্রমিস-৩’ নামের অভিযান শুরু করে ইরান।
শুক্রবারের (১৩ জুন) হামলায় ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, শীর্ষ কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বলে দাবি করেছে ইসরাইল।
এ হামলায় অন্তত ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় বলে জানায় দেশটির সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল।
ওইদিন ভোররাত থেকে একের পর এক বিমান হামলা প্রথমে ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা কাঠামোতে আঘাত হানে। এরপর ধারাবাহিক হামলায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং শেষে দেশটির বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজে হামলা চালানো হয়।
নাতানজের আংশিক ভূ-উপরিভাগে হওয়ায় সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে ইসরাইল। এছাড়াও হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এতে দেশটির প্রধান তিন সামরিক কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন সামরিক ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছেন।
ইরানের অভিজাত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, জরুরি কমান্ড ইউনিটের প্রধান জেনারেল গোলাম আলি রশিদ ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন।
এছাড়া ইরানের পরমাণু জ্বালানি সংস্থার (এইওআই) সাবেক প্রধান ফিরেদুন আব্বাসি ও তেহরানের ইসলামি আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মোহাম্মদ মেহদি তেরাঞ্চিসহ হামলায় দেশটির ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানী প্রাণ হারান। এ ধরনের নেতৃত্বশূন্যতা ইরানকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে তুলবে বলে শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
হামলার বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক বারকু ওজচেলিক বলেন, ‘তেহরানের গভীরে গিয়ে এমন নির্ভুল হামলা ইসরায়েলি গোয়েন্দা শক্তি ও সামরিক সক্ষমতার নিদর্শন।
এটি ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। এ হামলা কেবল একটি কৌশলগত ক্ষতি নয়, বরং ইরানের জন্য এক ভীষণ অপমান।’
ইরানের প্রধান সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজে কংক্রিট ও পাথরের সুরক্ষায় মাটির ৮ মিটার গভীরে অবস্থিত। হামলার পর সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে এলেও ভেতরের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করতে পারেনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। ইসরায়েলের দাবি— তারা সেই ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় গুরুতর ক্ষতি করেছে।
এদিকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ দাবি করেছে, তারা কমান্ডো অভিযান ও ড্রোন ব্যবহার করে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—যেমন এসফেজাবাদ এয়ারবেস- এ হামলা চালিয়েছে।
পাল্টা হামলায় প্রথম দফায় ইরান ১০০টির বেশি ড্রোন ছুড়েছে। তবে ড্রোনগুলো ছিল অত্যন্ত ধীরগতির। সবগুলো ড্রোনই মাঝপথে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল-ইরানের মধ্যবর্তী প্রায় ৭০০ মাইল অতিক্রম করতে সাত ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে ড্রোনগুলোর।
ইরানের হাতে এখনো প্রায় তিন হাজার উচ্চগতিসম্পন্ন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। তবে কেরমানশাহ অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোর ওপর হামলা হওয়ায় এসব অস্ত্রের কার্যক্ষমতা আছে কি-না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ইরান পরবর্তী প্রতিক্রিয়া— সাইবার হামলা, সন্ত্রাসী হামলা বা আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক চাপে রূপ নিতে পারে।
বিকল্প প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ইরান সাইবার হামলা বা ভিন্ন কোনো হামলার পথ বেছে নিতে পারে, যদিও সেগুলো সফল হলেও রাজনৈতিকভাবে হয়তো সমপর্যায়ের জবাব হিসেবে বিবেচিত হবে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো তেহরানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে, কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
এদিকে ইরানের অন্যতম আঞ্চলিক মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী জানিয়েছে, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসরায়েলের ওপর কোনো হামলা শুরু করবে না। অন্যদিকে হুথি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনের সেনাবাহিনী একাত্মতা জানালেও অবস্থান হাজার মাইল দূরে হওয়ায় তাদের ভূমিকাও সীমিত।