তার এত সম্পদের উৎস নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে
অনিয়ম-দুর্নীতির করে জিরো থেকে হিরো ময়মনসিংহ পৌর ভুমি কর্মকর্তা জীবন কুমার
- আপডেট সময় : ০৩:৩১:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫ ২১ বার পড়া হয়েছে
ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের দোসর ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জীবন কুমার বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। তার নিজ জেলা ময়মনসিংহের নিজ এলাকা নগরীর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সংলগ্ন কিসমত মৌজায় রয়েছে প্রায় ৬ একর জমি। এছাড়া ময়মনসিংহ নগরীসহ বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট, প্লট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। সুত্র জানিয়েছে ভূমি সহকারী পদে চাকুরী পাওয়ার পরই তিনি এসব সম্পদ উপার্জন করেছেন। এ যেনো আলাদীনের চেরাগ পাওয়ার মতোই একটি কাহিনী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে- ভূমি সহকারী কর্মকর্তা হিসাবে তিনি যেখানেই চাকুরী করেছেন সেখানেই ভূমি অফিসকে মগেরমুল্লুক আর ঘুষ দুর্ণীতির আখড়া বানিয়ে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জীবন কুমার বিশ্বাস । ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানির পাশাপাশি নিয়েছেন খজনার অতিরিক্ত টাকা। ঘুষের টাকা না পেলে সেবা গ্রহীতাদের হয়রানী করাসহ তার বিরুদ্ধে জমির নামজারি, ডিসিআর ও মিসকেসসহ না খাত থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জীবন কুমার বিশ্বাস বেশি হয়রানি করেন নামজারি, দাখিলা কাটা ও মিসকেস নিয়ে। নামজারীর জন্য অনলাইনে আবেদন করা হলেও প্রতিবেদন নিতে তাকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে প্রতিবেদন দিতে দেরী করে। এ ভাবে তিনি মানুষকে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে গড়েছেন অঢেল সম্পদ । আবার নামজারী কেস মঞ্জুর হলে ডিসিআরের জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবী করেন। এরপর হোল্ডিং নম্বরের জন্য ভূমি অফিসে গেলে সেখানেও থাবা বসান জীবন কুমার।
জীবন কুমার বিশ্বাস বর্তমানে তার নিজ এলাকা ময়মনসিংহ পৌর ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন। নিজ এলাকায় চাকুরির সুবাদে তার আচার-আচরণ, ক্ষমতার প্রভাব যেনো কোন সিরিয়াল কিলারকেও হার মানাবে। ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে হয়রানি করছেন সেবা গ্রহীতাদের। আবার টাকা পেলেই অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে- জীবন কুমার বিশ্বাস গত ১৯৯৬ সালে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা পদে চাকুরীতে যোগদান করেছেন। জেলার শিল্পাঞ্চল নামে খ্যাত ভালুকা উপজেলা সদর সহ হবিরবাড়ী ইউনিয়ন, মল্লিক বাড়ী ইউনিয়নে প্রায় ১২ বছর চাকুরী করে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক হন। ভালুকার মল্লিকবাড়ী ইউনিয়নের ভূমি সহকারী হিসাবে থাকাবস্তায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বোররচর ইউনিয়নে বদলী করা হয়, বোররচর ইউনিয়নে মাত্র ২২দিন চাকরী করে পাড়ি জমান ময়মনসিংহের পৌর ভূমি অফিসে। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ পৌর ভূমি অফিসেই কর্মরত আছেন। মাত্র ২৯ বছর চাকরি করেই গড়েছেন অঢেল সম্পদ। কানাঘুষা চলছে- ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। এসব সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে এমন কোনো অসাদু উপায় নেই যা জীবন কুমার বিশ্বাস ব্যবহার করেন নি।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে- ময়মনসিংহ নগরীর জিলা স্কুলের পাশে নজরুল সেনা স্কুল সংলগ্ন বাড়ী, নতুন বাজার সাহেব আলী রোড -বাউন্ডারি রোডের কোণায় ভীটু বিল্ডিং, ধোপাখোলা মোড়ের পাশে হান্নান সাহেবের গ্যারেজ সংলগ্ন ড্রীম টাওয়ার নামে বাড়ী নির্মাণ (চলমান কাজ) সহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সংলগ্ন কিসমত মৌজায় গড়েছেন প্রায় ৬ একর সম্পদ। ইতোমধ্যে ভবন কাজ সম্পন্ন হয়েছে যেগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
তার নিজ এলাকায় সমালোচনা চলছে- এক সময়ের নুন আনতে পানতা ফুরানো পরিবারের সন্তান ভূমি অফিসের সরকারী চাকুরিটা পেয়ে যেনো আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন। চেরাগ থেকে বেরিয়ে আসা জ্বীনের কাছে যেনো জীবন কুমার বাবু সম্পদ চেয়েছেন আর অমনি জ্বীন সাহেব এগুলো দিয়ে দিলো। তা না হলে একজন নায়েবের মাসে কত বেতন আর পরিবারের মাসিক খরচ শেষে কতটাকা আয় থাকে? তাহলে এই সম্পদের উৎস কোথায়? অনেকেই বলছেন দুদক তদন্ত করলেই সব থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
তার চাকরি জীবনের একাধারে বেশিরভাগ সময় কেটেছে ভালুকা উপজেলায় ভূমি সহকারী কর্মকর্তা হিসাবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুমি অফিসে নাইবের চাকরি পাওয়ার পর জীবন কুমার ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, জাল জালিয়াতিতে বেপরোয়া হয়ে উঠে। অনিয়মই যেনো তার কাছে নিয়ম। এমনটাই দাবী করেছে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নে তার কাছে সেবা নিতে আসা সেবাগ্রহীতারা। বিভিন্ন শিল্প কারখানা মালিকদের সাথে লিয়াজো করে জমির কাগজপত্র গড়মিল দেখিয়ে কোম্পানিকে কমমুল্যে জমি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়েও তিনি ছিলেন পারদর্শী।বিভিন্ন কোম্পানি মালিকগণ তাকে দিতেন মোটা অংকের অর্থ। এভাবে তার ষড়যন্ত্রের জালে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন এমন অভিযোগও উঠেছে। আওয়ামী লীগের ছোট বড় নেতাদের সাথে যোগসাজস করেও গড়েছেন অঢেল সম্পদ।
অনেকেই মনে করছেন আলাদিনের চেরাগ পেলেও হয়তো এতো অঢেল সম্পদ অর্জন সম্ভব না। নায়েব জীবন কুমারের কাছে কি আলাদিনের চেরাগ রয়েছে? এমন প্রশ্নকে সামনে রেখে তার ব্যাপারে টানা এক মাস অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে বেরিয়ে আসে তার টাকা কামানো আলাদিনের চেরাগের রহস্য।
ভালুকায় যোগদানের পর আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে যোগসাজস করে বড় বড় কোম্পানি মালিকদের জমি পাইয়ে দেয়ার সুবিধার্থে নয়ছয় করে সরকারী পুকুর লিজ, খাস জমি লিজ, মালিকানা জমির খাজনা খারিজে বাধ্যতামূলক ঘুষ রীতি চালু, জালিয়াতি করে সম্পদ গড়তে থাকেন তিনি। এমন কি সরকারী জায়গা পজিশন বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নায়েব জীবন কুমার বিশ্বাস উপজেলা ভুমি অফিসে চাকরি করার সময় শুধু পজিশন দেয়ার নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়েছে কোটি টাকা। একেকজন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ- লাখ টাকা নিয়ে পরিজশন না দিয়ে শুধু ভুয়া ডিসিআর দেয়া হয়। টাকা নিলেও কোনো ব্যবসায়ীকে তিনি পজিশন বুঝে দেননি।
বিগত সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে যোগসাজস করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সরকারি জায়গা জালিয়াতি করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে করে দেন এই ভূমি সহকারী কর্মকর্তা। নামে বেনামে সমিতি করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে আতাত করে লিজ দেন । আর সেখান থেকেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। মূলত ভুমি অফিসে তিনি খাজনা খারিজের একটি নিয়ম চালু করেছিলেন। এক দলিলে এক বিঘা জমি থাকলে খাজনা বা খারিজ করতে তাকে সর্বনিম্ন ৫-১০ হাজার টাকা দিতে হতো। খাজনা খারিজের জন্য ৫০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা রেট বেধে দেয় নায়েব
জীবন কুমার বিশ্বাস । আর এ টাকা দেওয়া একটা শিল্প কারখানার মালিকের জন্য কোন কষ্টকর বিষয় না, একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভালুকা উপজেলা প্রশাসন তাকে বদলী করার সুপারিশ করে।
সরেজমিনে ভালুকায় হবিরবাড়ী ও মল্লিকবাড়ী ইউনিয়নে গিয়ে খোজ নিলে তার সম্পর্কে যায়, নামজারি, জমাভাগ, খাজনা আদায়, জমির পর্চা (খসড়া) তোলা সহ ভূমি সংক্রান্ত সকল কাজে সরকার নির্ধারিত অর্থের বাইরেও বাড়তি টাকা নিতেন তিনি। চুক্তি ছাড়া কোন কাজ সম্পন্ন করেনি, আর চুক্তি অনুযায়ী টাকা না দিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন সেবা পায়নি সেবাগ্রহীতারা। বাড়তি টাকা আদায়ের বাইরেও গ্রাহকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হয়রানির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে, নাযেব জীবন কুমার বিশ্বাস ভালুকায় থাকাবস্থায় বিভিন্ন শিল্পকারখানার মালিক ও আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় নেতাদের সাথে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার মাধ্যমে ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে বনে গেছেন কোটি-কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়। এছাড়াও ময়মনসিংহ শহরে জীবন কুমার বিশ্বাসের নিজস্ব একাধিক দোকান পাট রয়েছে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তদন্ত করে জীবন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন। তাদের মতে,নায়েব জীবন কুমার সরকারি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার খর্ব করছেন।
ময়মনসিংহ পৌর ভূমি অফিসে যোগ দেওয়ার পরও তার অপকর্ম বন্ধ হয়নি। এখানেও তিনি ঘুষের বিনিময়ে জনগণের কাজ দ্রুত সমাধান করে চলেছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভূমি অফিসে ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেই জীবন বাবু বর্তমানে জিরো থেকে হিরো হয়ে উঠেছেন। তা না হলে এমন বিপুল পরিমাণ টাকা অর্জন কীভাবে সম্ভব হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
ময়মনসিংহ পৌর ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, এই অফিসের কর্মকর্তা জীবন বাবু সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের তার চাহিদামত টাকার বিনিময়ে চুক্তির বাইরে কোন সেবা পাচ্ছেনা। তার এসব অনিয়ম যেনো দেখার কেউ নেই।
অভিযোগ উঠেছে- নায়েব জীবন কুমার বিশ্বাস সেবা গ্রহীতাদের উপর প্রভাব খাটান। তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন। একটি সুত্র জানিয়েছে-জীবন বাবুর এক ভাগিনা তার প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দালালী করে বেড়ায়। কথা মতো কাজ করে না দিলে মামার প্রভাবে ভাগিনা বিভিন্ন নায়েবদের মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি ও বদলী করে।
এব্যাপারে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জীবন কুমার বিশ্বাস এর বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে তার এত সম্পদের উৎস কি? চাকুরীতে যোগদানের পুর্বে যাকে ভূগতে হয়েছিলো আর্থিক সংকটে চাকুরী পাওয়ার পর কিভাবে এত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তার এই সম্পদের উৎস বের করে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়াও দাবী উঠেছে সচেতন মহলের মাঝে।























